অনলাইন ডেস্কঃ
আগামীকাল ১২ রবিউল আউয়াল পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী অথবা বিশেষ তাৎপর্যের সাথে পালিত হবে সিরাতুন্নবী। মহান আল্লাহ পথহারা মানবকুলকে পথের দিশা দেওয়ার জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন। তারই ধারাবাহিতায় প্রেরণ করেন সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে। তিনি এসে আল্লাহর দীক্ষা আর কোরআনি শিক্ষার আলোয় আলোকিত করেছেন গোটা বিশ্বকে। পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সঃ) এই দিনেই আমাদের প্রিয় নবী, শেষ নবী, নবীকুলের শিরোমণি, বিশ্বমানবতার প্রার্থনায় হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জন্মও মৃত্যু বরণ করেন। ১২ রবিউল আউয়ালকে মুসলিম বিশ্ব মহানবীর জন্ম ও ওফাতের দিবস হিসেবে পালন করে থাকেন। এ দিবসটি একই সঙ্গে আনন্দের এবং দুঃখের। তাই এই দিনটি বিশেষ তাৎপর্যের সাথে পালিত হয় সিরাতুন্নবী হিসেবেও।
ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান সৌদি আরবে অবস্থিত মক্কা নগরীর কুরাইশ গোত্রের বনি হাশিম বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের তারিখ ছিল ১২ ই রবিউল আউয়াল, ইংরেজি সন মোতাবেক ৫৭০ খৃস্টাব্দে। তবে তাঁর জন্মের সুনির্দিষ্ট তারিখ কোনটি সে সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। রসুলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে স্বীয় জন্ম তারিখ সম্পর্কে কোন বিবরণ পাওয়া যায়না। তাঁর জীবনীকারদের মধ্যে তিনি কবে জন্ম গ্রহণ করেছেন তা নিয়ে মতভেদ আছে। প্রখ্যাত ইতিহাসবেত্তা মন্টগোমারি ওয়াট তার পুস্তকে ৫৭০ সনই ব্যবহার করেছেন। এক বর্ণনা মতে তাঁর জন্ম ৫৭১ সালের ২০ বা ২২ শে এপ্রিল। তবে নবীর প্রকৃত জন্মতারিখ বের করা বেশ কষ্টসাধ্য। এজন্যই এ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। ঐতিহাসিক ও হাদিস বর্ণনাকারীদের সিংহভাগের মতে, তিনি রবিউল আউয়াল মাসে জন্মগ্রহণ করেন। এ মাসের কোন তারিখে মহানবীর (সঃ) জন্ম তা নিয়ে ইসলামের দুটি প্রধান সম্প্রদায় সুন্নি ও শিয়াদের মত ভিন্নতা লক্ষণীয়। সুন্নি মতাবলম্বীদের সিংহভাগ ১২ রবিউল আউয়াল সোমবারকে মহানবীর জন্মদিন বলে ভাবেন। অন্যদিকে সিংহভাগ শিয়া ইতিহাসবিদ ও জীবনীকারের মতে, হজরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর জন্ম ১৭ রবিউল আউয়াল শুক্রবার। শিয়া জীবনীকারদের মধ্যে একমাত্র আল কুলাইনী মনে করেন, ১২ রবিউল আউয়ালেই মহানবী (সঃ)-এর জন্ম।
মহানবী (সঃ)-এর জন্মদিন সম্পর্কে মতভিন্নতার কারণ হলো তিনি যে সময় জন্ম নেন সে সময় আরবদের মধ্যে দিন ও পঞ্জিকা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না। মহানবী (সঃ)-এর জীবনীকার তের শতকের ইতিহাসবিদ আল-ইরবিলি এ ধারণাই দিয়েছেন। স্মর্তব্য, শুধু মহানবী (সঃ) নয়, খ্রিস্টান ধর্মের প্রবর্তক হজরত ঈশা (আঃ) বা যিশুখ্রিস্টের জন্ম তারিখ নিয়েও রয়েছে একই ধরনের বিভ্রান্তি। ২৫ ডিসেম্বরকে যিশুর জন্মদিন হিসেবে পালন করা হলেও এর পক্ষে কোনো গ্রহণযোগ্য দলিল নেই। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম তারিখ সম্পর্কে ঐতিহাসিক এবং সীরাতকারগণের মধ্যে যদিও মতভেদ রয়েছে, তথাপি তারা এ বিষয়ে একমত যে, মহানবী (সঃ) রবিউল আউয়াল মাসের প্রথম পক্ষে সোমবার জন্মগ্রহণ করেছেন এবং তা ৮ থেকে ১২ তারিখের মধ্যকার কোনো একদিন ছিল। সাইয়েদ সোলাইমান নদভী, সালমান মনসুরপুরী এবং মোহাম্মদ পাশা ফালাকির গবেষণায় এই তথ্য বেরিয়ে এসেছে। তবে শেষোক্ত মতই ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বেশী নির্ভরযোগ্য। যাই হোক, নবীর জন্মের বছরেই হস্তী যুদ্ধের ঘটনা ঘটে এবং সে সময় সম্রাট নরশেরওয়ার সিংহাসনে আরোহনের ৪০ বছর পূর্তি ছিল এ নিয়ে কারো মাঝে দ্বিমত নেই।
অপর দিকে রসুলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মৃত্যু দিবস হল ১২ রবিউল আউয়াল সর্বসম্মতভাবে স্বীকৃত। বিদায় হজ্জ থেকে ফেরার পর হিজরী ১১ সালের সফর মাসে মুহাম্মদ (সঃ) জ্বরে আক্রান্ত হন। জ্বরের তাপমাত্রা প্রচন্ড হওয়ার কারণে পাগড়ির ওপর থেকেও উষ্ণতা অনুভূত হচ্ছিল। অসুস্থ অবস্থাতেও তিনি এগারো দিন নামাজের ইমামতি করেন। অসুস্থতা তীব্র হওয়ার পর তিনি সকল স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে আয়েশা (রাঃ)এর কামরায় অবস্থান করতে থাকেন। তাঁর কাছে সাত কিংবা আট দিনার ছিল, মৃত্যুর একদিন পূর্বে তিনি এগুলোও দান করে দেন। বলা হয়, এই অসুস্থতা ছিল খাইবারের এক ইহুদি নারীর তৈরি বিষ মেশানো খাবার গ্রহণের কারণে। অবশেষে ১১ হিজরী সালের রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে তিনি মৃত্যবরণ করেন। এ সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। আলী (রাঃ) তাকেঁ গোসল দেন এবং কাফন পরান। আয়েশ (রাঃ)এর কামরার যে স্থানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন, জানাযার পর সেখানেই তাকেঁ দাফন করা হয়। এ থেকে প্রতিয়মান হয় যে দিনটিতে আমাদের প্রিয় নাবীর জন্মদিন হিসেবে পালন করা হয় সে দিনটি তাঁর মৃত্যু দিবস ও। সুতরাং এদিনটি পালন করতে হলে একই সাথে উৎসব ও দুঃখ প্রকাশ করতে হয়। কিন্তু আমরা দুঃখ প্রকাশ না করে ঈদে মিলাদুন্ববী অর্থাৎ খুশিকেই বেশী গুরুত্ব দিয়ে থাকি। প্রকারন্তে এটাকে দুঃখের দিনে খুশি হওয়ার সামিল।
মুসলমান হিসেবে প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) জন্ম মাস রবিউল আউয়ালে আমরা সবাই আন্দোলিত হই। প্রিয়নবীর প্রতি আমাদের ব্যাকুল অন্তরের আকুল অনুভূতির প্রকাশ ঘটে। মহব্বতে রাসূলের নতুন হাওয়া বইতে থাকে চারদিকে। তবে আমাদের মহব্বতের প্রকাশভঙ্গিটা যথার্থ কি-না তা বিবেচনার দাবি রাখে। অনুষ্ঠানের হিড়িক, চোখ ধাঁধানো চাকচিক্য এবং মহব্বতে রাসূলের সস্তা প্রয়োগের কারণে মাহে রবিউল আউয়াল আমাদের জীবনধারায় কোনোই পরিবর্তন আনতে পারে না। গতানুগতিক বহমান স্রোতে পণ্ড হয়ে যায় রবিউল আউয়ালের প্রকৃত চেতনা ও দাবি। রবিউল আউয়ালের পয়গাম ও দাবি কী, সেগুলোও আমাদের কাছে আজ স্পষ্ট নয়। আনুষ্ঠানিকতার সব আয়োজনই আমরা সম্পন্ন করি, কিন্তু এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও শিক্ষা, বাস্তবজীবনে নববী আদর্শের কোনো ছাপ রাখতে পারি না। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম যথার্থই বলেছেনঃ’রবিউল আউয়াল এলে তোমারই গান গাই,রবিউল আউয়াল গেলে তোমায় ভুলে যাই।’মিলাদ, কিয়াম, জশনে-জুলুশ আর অনুষ্ঠানসর্বস্ব রবিউল আউয়াল আমরা যতই উদযাপন করি, প্রাপ্তির খাতায় শূন্যতা থেকেই যাবে। এ জন্য সিরাতুন্নবীর যথার্থ দাবি আদায়ের প্রতি মনোযোগী হওয়া ইমানদীপ্ত চেতনার সর্বপ্রধান দায়িত্ব।
বিশ্বমানবতার মুক্তির দিশারী, সারওয়ারে কাওনাইন, রাহমাতুল্ লিল আলামীন, শাহানশাহে আরব ও আজম বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পৃথিবীতে শুভাগমন নিঃসন্দেহে ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা। রূহানী দুনিয়া থেকে বস্তুজগতে মহানবীর (সঃ) আবির্ভাব সত্যি সত্যিই বিশ্বস্রষ্টা মহান রাব্বুল আলামীনের এক অপার করুণা। তাঁর আগমনে শিরক, পৌত্তলিকতা, জাহেলিয়াত ও বর্বরতা দূরীভূত হয়। তাঁর শুভাগমনে বিশ্বের সৌভাগ্যের দ্বার উন্মুক্ত হয়। এমন মহামানবের জীবনচরিত আলোচনা একটি বড় এবাদত। তাঁর পবিত্র জীবনের প্রতিটি ঘটনা মানুষের হেদায়েতের জন্য উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা।
আমি ধর্ম সম্পর্কে বিশেষ কিছু যানিনা বলেই আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে এই প্রশ্নটি দেখা দিয়েছে যে এই পবিত্র দিনটিকে কেউ ঈদে মিলাদুন্নবী আবার কেউ কেউ সিরাতুন্নবী হিসেবে পালন করেন।মিলাদুন্নবী রসুল পাক হযরত মোহাম্মদ (সঃ) জন্মদিন। অর্থাৎ খুশির দিন। তবে এদিন তো তাঁর ওফাত দিবসও যা শোকের বা দুঃখের। শোকের দিবসে খুশি আমার কাছে ঠিক পরিস্কার নয়। তাছাড়া হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) তার জিবদ্দশায় তাঁর জন্মদিন পালন করেছেন এমন কোন ঐতিহাসিক দলিল নেই বলে শুনেছি এমনকি তাঁর সাহাবারাও তাঁর জন্মদিন পালন করেছেন এমন তথ্য পাওয়া যায়নি। তাই ঈদে-মিলাদুন্নবি প্রথাটি কুর’আন অথবা সহিহ সুন্নাহ এমনকি নবীজির জিবদ্দশায় যেমন পালন করা হয় নাই তেমনি কোন সাহাবিদের আমল থেকে প্রমাণিত নয়। যদি এটা শুধু কল্যাণের কাজই হতো তাহলে আমাদের চেয়ে তারাই এ কাজটি বেশী করতেন। কেননা তারা আমাদের চেয়েও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বেশী সম্মান করতেন ও ভালবাসতেন এবং কল্যাণের কাজে তারা ছিলেন বেশী আগ্রহী।তা ছাড়া বিশ্বের সর্ব শ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর জন্ম কিংবা মৃত্যু দিবস পালন হোক সৃষ্টিকর্তা হয়তো তা চান নি বলেই একই দিন তাঁর মৃত্যু ও জন্ম দিবস নির্ধারণ করেছেন। যাতে করে হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর জন্ম কিংবা মৃত্যু দিবস মানুষ উৎসব মুখর পরিবেশে আথবা দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে পালন না করে। খুশি ও বেদনা হত এই দিনটি যেন কোন ভাবেই পালন না করে নীরবে তার উপর দরুদ (সঃ) পড়ে। সুতারাং এই ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করা কতটুকু যুক্তি সংগত যে দিন আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর ওফাত দিবসে। সম্ভবতঃ হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর ওফাতের ৬০০ বছর পরে তাঁর জন্মদিন পালনের প্রচলন হয়।
সুতরাং ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখে ঈদে মিলাদুন্নবী পালন শরিয়ত মতে কতটুকু গ্রহণযোগ্য সে প্রশ্ন আমার। তবে বিশ্বমানবতার আশীর্বাদ হজরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর জন্মও মৃত্যু দিবসকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে আমরা সিরাতুন্নবী হিসেবে এই দিনকে অথবা বছরের যে কোন একটি দিনকে পালন করতে পারি। অপরদিকে ঈদে মিলাদুন্নবী হলো আমাদের পেয়ারা নবীরজীর জন্মদিনের মাঝে সীমাবদ্ধ, এতে তাঁর জীবনের সামান্যতম অংশই আলোচনা করার সুযোগ থাকে অথচ সিরাতুন্নবী হিসেবে বছরের যে কোন দিনে তার জীবনী আলোচনা করে আমরা দো জাহানের অশেষ নেকী অর্জন করতে পারি। কারণ হজরত মোহাম্মদ (সঃ) এর জীবনে একটি দিবসে গন্ডিতে না থেকে তার ৬২ বছরের জীবনের আলোচনা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া তাঁর জন্মদিনের আদর্শ বাস্তবায়ন না করে তার সমগ্র জীবনের আদর্শ বাস্তবায়ন করা বা করার চেষ্টা করা বা করতে উদ্বুদ্ধ করা হজরত মোহাম্মদ (সঃ) এর উম্মত হিসেবে আমাদের নৈতিক দ্বায়িত্ব ও কর্তব্য। বিশেষ করে এই পবিত্র দিনে আমরা মহানবী (সঃ)-এর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও সালাম জানাই। হানাহানি ও অশান্তিতে ভরা এই বিশ্বে শান্তি স্থাপনে তার রেখে যাওয়া আদর্শ মানব জাতিকে সঠিক পথ দেখাতে পারে। মানব জাতির জন্য যার প্রয়োজন আজ সবচেয়ে বেশি।
এ বিষয়ে আমি ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে অভিজ্ঞ বন্ধুদের কাছ থেকে সুচিন্তিত মতামত আশা করছি যা আমাদের সঠিক ভাবে হজরত মুহাম্মদ (সঃ) এর জন্মদিন বা তার সারা জীবনের আদর্শ অর্থাৎ সিরাতুন্নবী পালনে উদ্বুদ্ধ করবে। আল্লাহ আমাদের সকলকে সহি বুঝবার তৌফিক দান করুন। আমিন-