Tuesday , 15 October 2024
E- mail: news@dainiksakalbela.com/ sakalbela1997@gmail.com
ব্রেকিং নিউজ
নির্বাচনে পিআর পদ্ধতির দিকে ঝুঁকছে বাংলাদেশ

নির্বাচনে পিআর পদ্ধতির দিকে ঝুঁকছে বাংলাদেশ

অনলাইন ডেস্কঃ

ব্যক্তি নয়, দলের সার্বিক ভোটপ্রাপ্তিতে নির্ধারণ হবে সংসদে আসন। আর একটি দল প্রকৃত অর্থেই সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসতে পারবে। মাত্র কয়েক শতাংশ ভোট কমবেশি হওয়ার কারণে সংসদে আসন পাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক ব্যবধান সৃষ্টি হবে না। কোনো দল ৪০.২১ শতাংশ ভোট পেয়েও সংসদে মাত্র ৬২টি আসন বা ৩২.৫০ শতাংশ ভোট পেয়ে মাত্র ৩০টি আসন পাওয়ার ঘটনা আর ঘটবে না।

দাবিটি পুরনো। এক যুগের বেশি সময় আগে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে সংলাপে সিপিবির লিখিত প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, নির্বাচনে জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটাতে বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। এ ক্ষেত্রে অন্যতম করণীয় হচ্ছে প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) বা সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন।

সমাজের সব স্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব ও স্বার্থ নিশ্চিত করা এবং জুলাই অভ্যুত্থানের বার্তাকে প্রতিফলিত করার জন্য সাংবিধানিক সংস্কারের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন, তার অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন।

গত ২৮ আগস্ট ‘নতুন বাংলাদেশ : দুর্নীতি প্রতিরোধ, গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা’ শিরোনামে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে রাষ্ট্রকাঠামোতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের লক্ষ্যে ৯টি কৌশলগত বিষয়ের সুপারিশ তুলে ধরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এসব সুপারিশের অন্যতম ছিল সংসদ নির্বাচনে পিআর ব্যবস্থা।

এ পদ্ধতিতে ভোটাররা ব্যক্তিকে নয়, দলকে ভোট দেন। দলের ভোটপ্রাপ্তির হারের ওপর ওই দল কত আসন পাবে তা নির্ভর করে। ইউরোপের প্রায় সব দেশ এবং পার্শ্ববর্তী শ্রীলঙ্কা, নেপালসহ বিশ্বের ৯৭টিরও বেশি দেশে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে এই পদ্ধতি চালু রয়েছে।

২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রদত্ত মোট ভোটের ৪০.৮৬ শতাংশ পেয়ে বিএনপি জাতীয় সংসদে আসন পেয়েছিল ১৯৩টি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ৪০.২১ শতাংশ ভোট পেয়ে আসন পায় মাত্র ৬২টি। কিন্তু  দেশে বিদ্যমান ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট পদ্ধতির বদলে পিআর পদ্ধতি চালু থাকলে ফল হতো ভিন্ন। এই পদ্ধতিতে ওই নির্বাচনে বিএনপি ১২২টির কাছাকাছি আর আওয়ামী লীগ অন্তত ১২০টি আসন পেত।

২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে দলগুলোর আসনপ্রাপ্তিতে সামঞ্জস্য ছিল না। ওই নির্বাচনে ৪৮.০৪ শতাংশ ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগ ২৩০টি আসন পেয়েছিল, অন্যদিকে বিএনপি ৩২.৫০ শতাংশ ভোট পেয়ে আসন পায় মাত্র ৩০টি। পিআর বা সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি থাকলে ওই নির্বাচনে বিএনপি পেত অন্তত ৫৭টি আসন।

এ বিষয়ে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমাকে নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান করা হয়েছে। দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার জরুরি। পিআর পদ্ধতি দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সহায়ক হবে বলেই অনেকের ধারণা। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবার মতামতের ভিত্তিতে কমিশন থেকে সুপারিশ করা হবে। কমিশনের প্রধান হিসেবে এ বিষয়ে আমি আমার ব্যক্তিগত মতামত দেওয়া থেকে বিরত থাকতে চাই।’

২৮ আগস্টের সংবাদ সম্মেলনে রাষ্ট্রকাঠামোতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের লক্ষ্যে ৯টি কৌশলগত বিষয়ের সুপারিশ তুলে ধরে টিআইবি। এসব সুপারিশের অন্যতম ছিল সংসদ নির্বাচনে পিআর ব্যবস্থা এবং নির্বাচনের জন্য দলনিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন।

স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদও মনে করেন, সংসদে সংখ্যানুপাতিক ভোটের পদ্ধতি চালু করা গেলে পরিস্থিতি পাল্টাবে। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, ‘গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমরা দেখেছি, বিদ্যমান ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট পদ্ধতিতে ভোটপ্রাপ্তিতে প্রধান দুই দলের মধ্যে তেমন পার্থক্য না থাকলেও সংসদে আসনপ্রাপ্তিতে ব্যাপক পার্থক্য ছিল। এতে ক্ষমতাকাঠামোতে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। কিন্তু পিআর পদ্ধতির নির্বাচনে সেটি হবে না। তখন আদর্শভিত্তিক ছোট দলগুলোও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। তারা বড় দলগুলোকে চাপ দিতে পারবে। সে ক্ষেত্রে জোট হবে নির্বাচনের পরে আর বড় দলগুলো ছোটদের শর্ত মেনেই সে পথে হাঁটবে।’

ড. তোফায়েল আহমেদ তাঁর ‘সংস্কার সংলাপ’ (সূচনা সূত্র) বইয়ে পিআর পদ্ধতির সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে আলোচনা করে এই পদ্ধতি গ্রহণ করার সুপারিশ করেছেন।

 

দলগুলো যা বলছে

২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে সংলাপে সিপিবির লিখিত প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, ‘সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব’ ব্যবস্থা অনুযায়ী নির্বাচনের আগে জাতীয় সংসদের নিজস্ব এখতিয়ারভুক্ত কাজকর্ম সম্পর্কে প্রস্তাব-পরিকল্পনা-কর্মসূচি-নীতি বর্ণনা করে রাজনৈতিক দলগুলো দেশবাসীর সামনে নিজ নিজ ইশতেহার উপস্থিত করবে। দেশবাসী এসব ইশতেহারের মধ্য থেকে যে দলের ইশতেহারে তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন দেখতে পাবে, সেই দলের মার্কায় ভোট দেবে।

যে দল যত শতাংশ ভোট পাবে,  সে দল জাতীয় সংসদে সেই অনুপাতে প্রতিনিধি পাঠাবে। অর্থাৎ  মোট আসন যদি ৩০০ হয়, তাহলে  কোনো দল ৫০ শতাংশ ভোট পেলে ১৫০টি আসন পাবে। ঐকমত্যের প্রয়োজনে নতুন ‘সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব’ ব্যবস্থাও আংশিকভাবে (অর্ধেক আসনে) অব্যাহত রাখা যেতে পারে। সবার মতামতের ভিত্তিতে এই অনুপাত কমবেশিও করা যেতে পারে। এই ব্যবস্থায় সংসদ সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তির কাজে দলীয় প্রধানের বা নেতৃত্বের কোটারির স্বেচ্ছাচারিতা রোধ করার জন্য দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা বিধিবদ্ধভাবে বাধ্যতামূলক করতে হবে।

২০১১ সালে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে সিপিবি ছাড়াও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাতীয় পার্টিসহ কয়েকটি দল একই প্রস্তাব রাখে। সে সময় তৎকালীন নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদা বিষয়টি সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘এটা হলে নির্বাচনে কালো টাকা ও পেশিশক্তির প্রভাব কমবে। আবার কিছু অসুবিধাও রয়েছে। আপনারা এই দাবি অব্যাহত রাখেন। একসময় হয়তো বিষয়টি সবার ওপর আছর করতে পারে।’

তবে বড় কয়েকটি দল এখনো পিআর পদ্ধতি নিয়ে আগ্রহ দেখায়নি। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই বিষয়ে বলেন, ‘এ ধরনের নির্বাচনপদ্ধতির বিষয়ে আমাদের দলে কোনো আলোচনা হয়নি। বিএনপি এখনো বর্তমান পদ্ধতি অনুসরণ করে নির্বাচনের পক্ষে।’

পিআর পদ্ধতি সম্পর্কে সদ্য ক্ষমতা হারানো দল আওয়ামী লীগের বর্তমান অবস্থান জানা সম্ভব হয়নি। তবে ২০১৫ সালে বিবিসি বাংলাদেশ সংলাপে আওয়ামী লীগ নেতা ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বলেছিলেন, ‘এই পদ্ধতি চালু করতে হলে পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও সহনশীলতা দরকার, পাশাপাশি পূর্ণাঙ্গ আলোচনা দরকার, কারণ পদ্ধতিটি খারাপ নয়। ভালো বলেই অনেকে গ্রহণ করেছে।’

জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে জানা যায়, দলটির নেতারা পিআর পদ্ধতির সুবিধা-অসুবিধাগুলো খতিয়ে দেখছেন।

সামনের নির্বাচনে কি পিআর পদ্ধতি সম্ভব

কয়েক দিন আগে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সংস্কারের ধারাবাহিকতায় ১৮ মাসের মধ্যে গণতন্ত্রে উত্তরণ ঘটা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন। আর প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস নিউইয়র্কে স্থানীয় সময় গত মঙ্গলবার (বাংলাদেশে বুধবার) বলেছেন, কমিশনগুলোর কাছ থেকে পাওয়া সুপারিশ নিয়ে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে। সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যে উপনীত এবং ভোটার তালিকা তৈরি হলে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হবে। এতে সুপারিশগুলোর বাস্তবায়ন নির্বাচনের পর না আগে হবে তা স্পষ্ট হয়নি বলেই অনেকের ধারণা। তাঁরা বলছেন, মৌলিক কিছু সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য সংবিধানের প্রয়োজন হবে। নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি চালু করতেও সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন। প্রশ্ন উঠেছে, জাতীয় সংসদ ছাড়া সংবিধান সংশোধন কি সম্ভব? সম্ভব না হলে আগামী নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি চালু হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক এ বিষয়ে বলেন, ‘নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি চালুর সুপারিশে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলে আসন্ন নির্বচানের পরও এটা চালু করা যেতে পারে। একসঙ্গে সব কটি আসনে না করে পরীক্ষামূলকভাবে অল্প কিছু আসনে করা যেতে পারে এবং ক্রমান্বয়ে একসময় সব কটি আসনেই এই পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে।’

এ নিয়ে ভিন্নমতও রয়েছে। নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা জানিপপ-এর প্রধান অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ এ বিষয়ে  বলেন, ‘দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য পিআর পদ্ধতিতে আমাদের যেতেই হবে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন এই পদ্ধতিতে হওয়া উচিত। আমি মনে করি, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে নির্বাচনের আগেই সংবিধান সংশোধন করা সম্ভব।’

About Syed Enamul Huq

Leave a Reply