৭ অক্টোবর ১৫৭৬। রাজদরবারে পিনপতন নীরবতা, ভক্তি, ভালোবাসা ও আধ্যাত্মিকতার আবহে পরিপূর্ণ। হীরা, জহরত ও দামি অলংকারে সজ্জিত রাজদরবার আজ যেন শিল্পীর আঁকা স্থিরচিত্র মাত্র। দরবারের সভাসদ ও মন্ত্রিবর্গ—যাঁরা ঝলমলে পোশাক পরিধান করে আছেন, যাঁদের কোমরে শোভা পাচ্ছে ঐশ্বর্যের তরবারি তাঁদের মুখমণ্ডলে গর্ব-গরিমার পরিবর্তে প্রস্ফুটিত হয়েছে পবিত্র আভা।
সম্রাট আকবর হজে যেতে না পারলেও তিনি হজযাত্রীদের নানা ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। তিনি রাষ্ট্রীয় খরচে নাগরিকদের হজে পাঠানোর বিধান করেন। ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর জনসাধারণকে রাষ্ট্রীয় খরচে হজ করার আহবান জানান। সে বছর সুলতান খাজা নকশাবন্দির নেতৃত্বে বিরাট হজ কাফেলা প্রেরণ করেন। এ ক্ষেত্রে সাধারণ হজযাত্রীদের পাশাপাশি কিছু মানুষকে জোরপূর্বক আরব ভূখণ্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। যেমন—সম্রাট হুমায়ুন তাঁর দুই বিদ্রোহী ভাই শাহজাদা কামরান ও শাহজাদা মুহাম্মদ আস্কারিকে মক্কায় নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন এবং সেখানেই তাঁরা মৃত্যুবরণ করেন।
সম্রাট আকবর প্রতিবছর রাষ্ট্রীয় খরচে হজ কাফেলা পাঠাতেন। তিনি তাঁর আমলে ‘আমিরুল হজ’ (হজ কাফেলার প্রধান) পদ সৃষ্টি করেন। তিনি হজ কাফেলার সঙ্গে মক্কা-মদিনার অধিবাসীদের জন্য বিপুল পরিমাণ উপঢৌকন পাঠাতেন। সম্রাট আকবর হাজিদের বিদায় দেওয়ার সময় তাদের সাদৃশ্য গ্রহণ করতেন। যেমন—তিনি ইহরাম পরতেন, মাথার চুল ছোট করতেন, তালবিয়া পাঠ করতেন এবং খালি মাথায়, খালি পায়ে হাঁটতেন।
১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে আমিরুল হজ শাহ আবু তুরাব (রহ.) হজ থেকে ফিরে আসার সময় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পদচিহ্নবিশিষ্ট একটি পাথর নিয়ে আসেন। রাসুল (সা.)-এর স্মৃতিচিহ্নের প্রতি সম্মান এবং হাজিদের অভ্যর্থনা জানাতে আগ্রা শহরের বাইরে তিনি চার ফারসাখ পর্যন্ত হেঁটে যান।
আবুল ফজল আল্লামি লেখেন, ১৫৭৯ সালে সম্রাট আকবরের পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁর ফুফু গুলবদন বেগম, স্ত্রী সেলিমা সুলতান বেগমসহ রাজপরিবারের একাধিক নারী হজে গমন করেন। খাজা ইয়াহইয়া এই কাফেলার আমিরুল হজ ছিলেন। তাঁরা ১৫ অক্টোবর ১৫৭৫ সালে আগ্রা থেকে যাত্রা শুরু করেন এবং ১৫৭৬ সালের অক্টোবর মাসে সুরত থেকে দুটি জাহাজে করে মক্কা ও মদিনার উদ্দেশে রওনা হন। এই কাফেলা ১৫৭৭ সালে জেদ্দায় পৌঁছে এবং সেখানে প্রায় চার বছর অবস্থান করে। এই সময়ে তাঁরা চারবার হজ পালন করেন।
১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে হজ শেষে তাঁরা ফিরে এলে তাঁদের উষ্ণ অভ্যর্থনা দেওয়া হয়। খাজা ইয়াহইয়ার মাধ্যমে মক্কার অভিজাত ব্যক্তিরা সম্রাটের কাছে সাহায্য চেয়ে একটি তালিকা পাঠিয়েছিলেন। এ ছাড়া সম্রাট মক্কা-মদিনার অসহায় ও দরিদ্র মানুষের তালিকা চেয়ে পাঠান এবং তাদের জন্য সাহায্য পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। পরের বছর সম্রাট তাদের দাবি অনুসারে উপহার ও সাহায্য পাঠান।
ঐতিহাসিক সূত্রগুলো বলে, প্রথম বছর সম্রাট আকবর তাদের জন্য ছয় লাখ রুপি এবং ১২ হাজার পোশাক পাঠান। পরের বছর পাঁচ লাখ রুপি ও ১০ হাজার পোশাক পাঠান। তৃতীয় বছর চার লাখ রুপি এবং ৯ হাজার পোশাক পাঠান। সম্রাটের সহযোগিতায় হিজাজে একটি মাদরাসা এবং কাদেরিয়া তরিকার খানকাও প্রতিষ্ঠিত হয়। মিথ্যা ধর্ম দ্বিনে এলাহির প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত সাহায্য পাঠানোর এই ধারা অব্যাহত ছিল। এরপর শুরু হয়েছিল সম্রাট আকবরের দুর্ভাগ্যের দিন।
পরবর্তী মোগল সম্রাটরা আরবে সাহায্য পাঠানোর এই ধারা অব্যাহত রেখেছিলেন। তবে এর উদ্দেশ্য শুধু ধর্মভক্তি ছিল না। তাদের কিছু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও ছিল। ইতিহাস গবেষকরা বলেন, মোগল সম্রাটরা বিপুল পরিমাণ উপহার পাঠাতেন কয়েকটি উদ্দেশ্যে : ১. মক্কা-মদিনার সঙ্গে ধর্মীয় সম্পর্ক ও পবিত্র ভূমির প্রতি সম্মান, ২. মুসলিম বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করা, ৩. মক্কা-মদিনার শাসকরা যেন ভারতীয় হাজিদের নিরাপত্তা ও অন্য সুযোগ-সুবিধার প্রতি সুদৃষ্টি দেন, ৪. আরব বিশ্বে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা।
তথ্যঋণ : ইনডিপেনডেন্ট উর্দু ও মক্কা নিউজ ডটএসএ