বাংলাদেশের ভূখন্ড ব্যবহার করে পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্য-সেভেন সিস্টার্সে পণ্য পরিবহনে সুবিধা নিলেও ভারতের ভূখন্ড ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানে পণ্য পরিবহনের সুযোগ পায়নি বাংলাদেশ। এই ট্রানজিট ছিল বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিগত ১৫ বছরে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। সেই ট্রানজিট থেকে একতরফা সুবিধা পেয়েছে ভারত।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ‘ট্রানজিট বলতে আমরা যা বুঝি অর্থাৎ একটি অঞ্চল বা উপ-অঞ্চলের মধ্যে সড়ক, নৌপথ, আকাশপথ এবং রেলপথে বহুমুখী ও কার্যকর যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলা; বিগত সময়ে সেটি বাস্তবায়ন হয়নি।
বাংলাদেশের চাওয়া পাওয়া :
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই ২০০৯ সাল থেকেই ট্রানজিট সম্পর্ক নিয়ে জোর তৎপরতা চালায় ভারত। কারণ ‘চিকেন নেক’ হয়ে ভারতের মূল অংশের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্য করতে হলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোকে গড়ে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিতে হয়।
যেমন আগরতলা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব মাত্র ৪০০ কিলোমিটার। তবে বাংলাদেশ চাইছিল দক্ষিণ এশিয়ায় একটি বহুমুখী উপ-আঞ্চলিক কার্যকর যোগাযোগব্যবস্থা চালু করতে। যেহেতু নেপাল ও ভুটান দুটি দেশই ভূমিবেষ্টিত রাষ্ট্র, সে কারণে ওই দুটি দেশের পক্ষ থেকেও বাংলাদেশের সঙ্গে ট্রানজিট-সুবিধা চালুর ব্যাপক আগ্রহ ছিল।
১৯৭২ সালের আইডব্লিউটিটি চুক্তি অনুযায়ী ভারত নৌ ট্রানজিটের জন্যে রয়্যালটি হিসেবে বাংলাদেশকে বার্ষিক ৫ কোটি টাকা দিয়ে আসছে। এই বরাদ্দ ছিল নৌপথ সচল রাখার জন্য ড্রেজিং খরচ বাবদ। ২০১০ সালে ভারতকে নৌপথে ট্রানজিট সুবিধা কার্যকরের গ্রিন সিগন্যাল দেওয়ার পর তখন বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় মতামত দেয় যে ড্রেজিংয়ের বাইরেও সড়ক ও নৌপথ ব্যবহারে ভারতীয় জাহাজের ওপর সুনির্দিষ্ট মাশুল আরোপ করা উচিত।
ওই মতামত পেয়ে ২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেটে নৌপথে ভারতের জাহাজ চলাচলে নির্দিষ্ট মাশুল আরোপের বিধান যুক্ত হয়। বাজেটে প্রবর্তিত বিধান অনুযায়ী জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ২০১০ সালের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতের পণ্যবাহী দুটি জাহাজের ওপর শুল্ক আরোপ করলে ভারতীয়রা ১৯৭২ সালের উপরিউক্ত চুক্তির দোহাই দিয়ে তা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। একপর্যায়ে এ নিয়ে দুই দেশের সরকার পর্যায়ে আলোচনার পর ওই শুল্ক আরোপ থেকে পিছিয়ে আসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার।
ফলে ভারতকে দেওয়া নৌ ট্রানজিটের জন্য ড্রেজিং খরচ ছাড়া আর কোনো সুবিধা পায়নি বাংলাদেশ। অর্থ, বাণিজ্য ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানায়, ২০১৬ সালের জুন থেকে ভারতকে বিদ্যমান নৌ-প্রটোকলের আওতায় প্রথমে কলকাতা-আশুগঞ্জ নৌপথ এবং তারপর আশুগঞ্জ-আখাউড়া সড়কপথ ব্যবহার করে ত্রিপুরার আগরতলায় পণ্য পরিবহনের সুযোগ দেয় বাংলাদেশ।
২০১৮ সালে দুই দেশের মধ্যে ‘অ্যাগ্রিমেন্ট অন দি ইউজ অব চট্টগ্রাম অ্যান্ড মোংলা পোর্ট ফর মুভমেন্ট অব গুডস টু অ্যান্ড ফ্রম ইন্ডিয়া’ চুক্তি হয়। পরবর্তী সময়ে ২০১৯ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালীন চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে অভ্যন্তরীণ ও তৃতীয় দেশের পণ্য পরিবহনের জন্য ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্টের রূপরেখা বিষয়ে এসওপি সই হয়।
২০২৩ সালের ২৪ এপ্রিল চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের সুবিধা দিয়ে স্থায়ী আদেশ জারি করে এনবিআর। ২০২৩ সালের ১ নভেম্বর আখাউড়া-আগরতলা রেল যোগাযোগ ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী। আর ক্ষমতা থেকে পতনের কয়েক দিন আগে গত জুনে ভারত সফরে গিয়ে বাংলাদেশের ভূখন্ড ব্যবহার করে ভারতকে রেল ট্রানজিট দেওয়ার সমঝোতা চুক্তি করে আসেন শেখ হাসিনা।
যেই চুক্তির আওতায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের গেদে-দর্শনা থেকে পণ্যবাহী রেল বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের ভূখন্ড ব্যবহার করে আবার হলদিবাড়ি-চিলাহাটি দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। সরকার পতনের পর এখন এসব ট্রানজিট চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকগুলো পর্যালোচনা করা উচিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ড. সেলিম রায়হান বলেন, প্রকৃত অর্থে একটি কার্যকর ট্রানজিট সম্পর্ক হতে হবে বহুমুখী। আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে এটি বাস্তবায়ন করতে হয়। যে দেশ সুবিধা দিচ্ছে, তার মাশুল, ফি নির্ধারণে সেই নীতি মেনে দরকষাকষি করতে হয়। কিন্তু ভারতের সঙ্গে এই দরকষাকষি সঠিকভাবে করা হয়নি। ফলে এ থেকে সুফলও নিতে পারেনি বাংলাদেশ। এখন এই বিষয়গুলো বিবেচনায় এনে বহুপাক্ষিক ট্রানজিটে নজর দিতে হবে বাংলাদেশকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অর্থনীতির আরেক শিক্ষক ড. মুহাম্মদ আবু ইউসুফ বলেন, দুটি দেশের মধ্যে যে কোনো সম্পর্ক বা চুক্তি হতে হয় দুই দেশের স্বার্থ রক্ষা করে। ট্রানজিটের ক্ষেত্রে সেই স্বার্থ রক্ষার ব্যত্যয় ঘটেছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সরকারের উচিত এ-সংক্রান্ত চুক্তিগুলো পর্যালোচনা করে দেশের স্বার্থ রক্ষায় উদ্যোগ নেওয়া।