একাধিকবার অবরুদ্ধ সময় এসেছে দেশে। কী সব দিন! ম্লান সকাল পেরিয়ে বিষণ্ন দুপুর। বিবর্ণ বিকেল পেরিয়ে বেদনাচ্ছন্ন সন্ধ্যা। তখন সংবিধান নামের পবিত্র গ্রন্থটি নির্বাসনে।
সেই দিনগুলোর দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। ২০০৭ সালের ১৫ মার্চ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা অসুস্থ পুত্রবধূ ও কন্যাকে দেখতে যুক্তরাষ্ট্রে যান। ৫ এপ্রিল নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করে, ভোটার আইডি কার্ড করে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচন অনুষ্ঠান দেড় বছরের আগে হবে না। ৭ এপ্রিল তিনি এক সাক্ষাৎকারে বিবিসি রেডিওকে বলেন, দীর্ঘদিন জরুরি অবস্থা দিয়ে দেশ চালানোর ফল শুভ হয় না। তিনি প্রশ্ন করেন, নির্বাচন করতে দেড় বছর লাগবে কেন? এর ঠিক দুই দিন পর ৯ এপ্রিল তেজগাঁও থানায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা হয় তিন কোটি টাকা চাঁদাবাজির মিথ্যা মামলা। শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি মামলার কোনো সত্যতা নেই। দেশে ফিরে তিনি মামলা মোকাবেলা করবেন। তিনি দেশে ফিরে আসার ঘোষণা দেন। ১৩ এপ্রিল শেখ হাসিনা ভয়েস অব আমেরিকাকে বলেন, তাঁকে দেশে ফিরতে দেওয়া না হলে তাঁর লাশ ফিরবে। তিনি লন্ডন হয়ে ২৩ এপ্রিল দেশে ফেরার সিদ্ধান্তের কথা জানান। ১৮ এপ্রিল সরকার প্রেস নোটের মাধ্যমে শেখ হাসিনার দেশে ফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সব এয়ারলাইনসকে জানিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে বহন না করার জন্য। এরই মধ্যে ১৯ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকন্যা লন্ডন পৌঁছেন। তিনি এ সময় লন্ডনে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেন এবং মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার দিতে থাকেন। ২৩ এপ্রিল ঢাকায় ফেরার সিদ্ধান্তে তিনি ছিলেন অনড়। কিন্তু ২২ এপ্রিল বোর্ডিং পাস সংগ্রহ করতে হিথরো বিমানবন্দরে গেলে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ তাঁকে ঢাকা ফ্লাইটে নিতে রাজি হয়নি। একই দিন তাঁর বিরুদ্ধে পল্টন হত্যা মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে সরকার তা আবার স্থগিত করে। ২৫ এপ্রিল সরকার শেখ হাসিনার দেশে ফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। বিভিন্ন ধরনের বাধা ও সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ৫২ দিন পর ২০০৭ সালের ৭ মে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসেন। বিমানবন্দরে বিপুলসংখ্যক মানুষ তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানায়।
আজ সেই ৭ মে। তৎকালীন সরকার ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনাকে সাজানো মামলায় গ্রেপ্তার করে। ২০০৮ সালের ১১ জুন তিনি মুক্তি পান। একই বছরের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট। সেই থেকে টানা চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
তিনি বর্তমান সরকারের যেমন প্রধান, তেমনি দেশের নেতা হিসেবে সব সংকটে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে নিরন্তর চেষ্টা, সেই অভিযাত্রায়ও তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
২০০৯ থেকে ২০২৪, গত ১৫ বছরে অভূতপূর্ব আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের দৃষ্টি কেড়েছে। বাংলাদেশ এখন সারা বিশ্বে একটি উন্নয়নের রোল মডেল। বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে একটি আত্মমর্যাদাশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। সম্প্রতি আইএমএফ বলেছে, ২০২৫ সাল থেকে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি বাড়তে শুরু করবে। একই সঙ্গে কমতে শুরু করবে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রবণতা। ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতেও অবদান বাড়বে বাংলাদেশের। এতে ২০২৮ সাল নাগাদ বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান হবে ১৯তম। বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ২৫তম। বাংলাদেশের অর্থনীতির এমন পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে ২০২৪ সালের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকের এপ্রিল সংস্করণে; যেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি ঐতিহাসিক মাইলফলকের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।
দেশসেবার ব্রতে রাজনীতিকে সত্য মেনেছেন তিনি। এই সত্য থেকে বিচ্যুত হননি কোনো দিন। সত্য ভাষণে কখনো পিছপা হননি।
এক কঠিন সময়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার হাতে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব দেয় এ দেশের মানুষ। গত ১৫ বছর দেশ পরিচালনায় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘দুরূহ কাজে’ ‘কঠিন পরিচয়’ দিতে পেরেছেন শেখ হাসিনা। অর্জন করেছেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আস্থা। গত ৮ জানুয়ারি নির্বাচনের পরদিন রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, ইরাক, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, ভারত, নেপাল, মালদ্বীপ, অস্ট্রেলিয়া, আয়ারল্যান্ড, জার্মানি, নরওয়েসহ বেশ কয়েকটি দেশের পর্যবেক্ষকরা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে এই বলে তাঁদের মত প্রকাশ করেন যে নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা জেফরি ম্যাকডোনাল্ড এক এক্স বার্তায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়ায় চারটি বিষয় থাকার কথা উল্লেখ করেন। এগুলো হলো আওয়ামী লীগের জয়কে স্বীকার, নির্বাচনপ্রক্রিয়ার সমালোচনা, সহিংসতার নিন্দা এবং অব্যাহত অংশীদারি এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যাশা। যুক্তরাষ্ট্রের উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ হলো, ‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে গুরুত্ব দিয়ে ঢাকার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান নীতি অপরিহার্যভাবে অব্যাহত থাকবে। তবে এর পাশাপাশি বাংলাদেশের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারি আরো জোরালো করার চেষ্টা অব্যাহত রাখবে যুক্তরাষ্ট্র।’ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার এক বিবৃতিতে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জনগণ এবং গণতন্ত্র, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য তাদের আকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন করে। যুক্তরাষ্ট্র দেখেছে, গত ৭ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন জিতেছে আওয়ামী লীগ।’
তার পরও বাংলাদেশ নিয়ে এখনো নানা ধরনের চক্রান্ত চলছে। একজন শেখ হাসিনা যাতে কোনোভাবেই সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে না পারেন, সেই লক্ষ্যে দেশে-বিদেশে সক্রিয় কুচক্রীমহল। বঙ্গবন্ধুকন্যা একাই তা মোকাবেলা করছেন। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, ‘আমাকে উত্খাত করলে পরবর্তীতে কে আসবে? কারা আসবে ক্ষমতায়? কে দেশের জন্য কাজ করবে, কাকে তারা আনতে চায়, সেটা কিন্তু স্পষ্ট নয়। আর সেটা স্পষ্ট নয় বলে তারা জনগণের সাড়া পাচ্ছে না।’ অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত তিনি কিন্তু জনগণের ওপরই পূর্ণ আস্থা রেখেছেন। আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ইতিবাচক দিকটি হচ্ছে আওয়ামী লীগ ও সরকারের নেতৃত্বে আছেন একজন শেখ হাসিনা।
বর্তমানের বাস্তবতা অস্বীকার করেন না তিনি। অতীত মনে রাখেন। দেখতে পান ভবিষ্যৎ। স্বপ্ন দেখতে পারেন। সেই স্বপ্ন ছড়িয়ে দিতে পারেন মানুষের মনের অলিন্দে। আর সে কারণেই আজকের দিনে শুধু নয়, আগামী দিনেও একজন শেখ হাসিনাকেই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
আমাদের সৌভাগ্য, তিনি আছেন আমাদের মাথার ওপর ছায়া হয়ে।
লেখক : আলী হাবিব, সাংবাদিক