Monday , 2 December 2024
E- mail: news@dainiksakalbela.com/ sakalbela1997@gmail.com
ব্রেকিং নিউজ
মুজিব-ভুট্টো সংলাপ
--সংগৃহীত ছবি

মুজিব-ভুট্টো সংলাপ

অনলাইন ডেস্কঃ

১৯৭১-এ বাংলাদেশের বিজয় দিবসে শেখ মুজিব মুক্ত ছিলেন না। মিয়ানওয়ালী কারাগার থেকে তাঁকে সম্ভবত সেনাবাহিনীর ধামিয়াল বিমানঘাঁটির একটি বাংলোতে নেয়া হয়। সেখানেই তাঁর ও ভুট্টোর মধ্যে বহুল আলোচিত সংলাপটি হয়।

ধামিয়াল ঘাঁটি রাওয়ালপিন্ডির দক্ষিণ দিকে।

১৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সালের নিউ ইয়র্ক টাইমসের সিডনি শ্যানবার্গ এক প্রতিবেদনে লিখেছেন,  মিয়ানওয়ালি কারাগারের সুপারিন্টেন্ডেন্ট মুজিবকে বের করে দিলে সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে বিমানে রাওয়ালপিন্ডি নিয়ে যাওয়া হয় এবং প্রেসিডেন্টের অতিথি ভবনে গৃহবন্দী রাখা হয়।

স্ট্যানলি ওলপার্ট তাঁর বইয়ে ‘ভুট্টো পারিবারিক গ্রন্থাগার ও মহাফেযখানা’য় (Bhutto Family Library and Archive BFLA) সংরক্ষিত মুজিব-ভুট্টো কথোপকথনের রেকর্ডের প্রতিলিপি থেকে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। নিচে সেই অংশ আক্ষরিক অনুবাদে উদ্ধৃত করা হলো।

ওলপার্ট ভুট্টোকে ডাকনামে ‘জুলফি’ লিখেছেন। এখানে পাঠকদের পরিচিত ‘ভুট্টো’ই লেখা হলো।

“ভুট্টো ১৯৭১ সালের ২০শে ডিসেম্বর পিন্ডিতে দায়িত্ব নেওয়ার এক সপ্তাহ পরের ঘটনা। তিনি নিজেই গাড়ি চালিয়ে সূর্যাস্তের পরে সামরিক বিমানবন্দরের কাছে একটি সুরক্ষিত সেনা বাংলোতে গেলেন। তার আগের দিন বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে হেলিকপ্টারে করে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

মার্চের শেষের দিকে ঢাকায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে তিনি কোনো সংবাদপত্র দেখেননি বা কোনো রেডিও শোনেননি। ক্লান্ত বন্দি মুজিব তার পুরান ‘বন্ধু’কে দেখে দুর্বলভাবে হেসে বললেন, ‘আমাকে এখানে আনার পর ভাবছিলাম আরেকটি বিপদ আসছে।’ তিনি বুঝতে পারছিলেন না তখনও কেন সেই ঘরে সশস্ত্র প্রহরীরা ছিল? এরপর ভুট্টো তাঁকে পিন্ডিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলেন। ‘আমি খুশি’, মুজিব জবাব দিলেন। ‘বিশ্বাস করুন আমি খুশি। বাংলার অবস্থা কি বলুন? আমি উদ্বিগ্ন হয়ে আছি।’ভুট্টো বোঝালেন যে ভারতের সেনাবাহিনী সোভিয়েত যুদ্ধজাহাজ এবং বিমানের সাহায্যে সোভিয়েত কামান এবং ট্রাক নিয়ে ঢাকা ‘দখল’ করেছে। মুজিব চিৎকার করে বললেন ‘তার মানে ওরা আমাদের মেরে ফেলেছে?’ ‘ভুট্টো ওরা আমাদের মেরে ফেলেছে … আপনি আমাকে ঢাকায় নিয়ে যান . . . আপনাকে কথা দিতে হবে যে ভারতীয়রা আমাকে জেলে ঢোকালে আমি আপনার সাহায্য পাব। আমার জন্য আপনি লড়বেন।’

‘আমরা একসাথে লড়বো, মুজিব’, ভুট্টো কথা দিলেন।

‘না, না’, মুজিব জবাব দিলেন, তিনি ভালো করেই জানেন কার সাথে কথা বলছেন এবং এটাও  জানেন যে, তাঁর প্রতিটি শব্দ ওই সুসজ্জিত বসার ঘরে রেকর্ড করা হচ্ছে। ‘আমাকে সেখানে ঝামেলাগুলো মেটাতে হবে। আমি জানি সেখানে দখলদার বাহিনী আছে। আমি নিশ্চিত আওয়ামী লীগ তাদের সরাতে পারবে না। পৃথিবী বুঝবে…আমি আপনার সাহায্য চাই। . . . বিশ্বাস করুন, আমি কখনও চাইনি ভারতীয়রা আসুক। আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন না?’

‘আমি আপনাকে বিশ্বাস করি’, ভুট্টো বললেন। ‘আপনি কি মনে করেন তা না হলে, আমি সঙ্গে সঙ্গে এই পদক্ষেপ নিতাম? আমি প্রথম কাজটি করেছি আপনার মুক্তির আদেশ দিয়ে এবং এখানে এসে।’

‘আচ্ছা, আপনি দায়িত্ব নিয়েছেন, আমি খুশি’, মুজিব আবারও বললেন, যদিও কথার সুরে মনে হয় না তিনি খুশি হয়েছিলেন। অদ্ভুত ‘সেফহাউসে’ ঘরটার চারদিকে তিনি সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছিলেন। হয়তো ভাবছিলেন তাঁর প্রিয় শহর ঢাকা, বা তার পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে আবার দেখা করার অনুমতি দেওয়া হবে কিনা। ‘আপনি কি সামরিক বাহিনীকে সরিয়ে দিয়েছেন?’

‘এখন এটা গৌণ ব্যাপার’, ভুট্টো এড়িয়ে জবাব দিলেন। ‘সেনাবাহিনী আর ফিরে আসবে না। আপনার যেকোনো শর্তে আমি শুধু আমার দেশের ঐক্য দেখতে চাই।’ তিনি তখনও ওই বন্দিকে ব্যবহার করে অতীতকে ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখছিলেন, সে এখন তাঁর বন্দি (যেমন ‘অবসরপ্রাপ্ত’ ইয়াহিয়াও তাঁর বন্দি ছিলেন), তিনি ইতিহাসের টেপ পুনরায় চালানোর, ওলট-পালট পাকিস্তানকে আবার একত্রিত করার স্বপ্ন দেখছিলেন। কেন নয়? তিনি কি এখন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ছিলেন না? আর এই বেচারা বাঙালির সঙ্গে কি তিনি ইচ্ছেমত ইঁদুর-বিড়াল খেলতে, খোঁচা দিতে বা সুড়সুড়ি দিতে পারবেন না? ‘আমি শুধু আমার দেশের ঐক্য দেখতে চাই’, তিনি ‘আমার দেশ’ বলেছিলেন, আমাদের নয়। কারণ তিনি তখনও মুজিবকে অবিশ্বাস করেছিলেন ঠিক যতটা মুজিবও অবিশ্বাস করেছিলেন।

‘না, কোন শর্ত নেই’, তাঁর লাল চোখের দিকে তাকিয়ে খারাপ কিছু সন্দেহ করে মুজিব তাকে বললেন, ‘বলুন আমার দেশের অবস্থা কি।’

‘মুজিব ভাই, আমাদের কী একসাথে বসবাস করার কোনো সম্ভাবনা আছে?’

‘আমি ঢাকায় জনসভা করব’, মুজিব বললেন। ‘আমার লোকদের সাথে দেখা করে, তাদের সাথে আলোচনা করে আপনাকে জানাব। আমি ওয়াদা করলাম… আমি একটু একটু করে বলবো . . তারা আমার কথা শুনবে। ইনশাআল্লাহ আমরা কিছু একটা করবো। আমি এখনই তার কিছু বলতে পারছি না। আপনি হয়তো আমার অবস্থান বুঝতে পারছেন।’ তিনি প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনা করছেন এটা মনে রেখে নিজের আওয়ামী লীগের সঙ্গীদের কথা ভেবে তিনি আতঙ্কিত ছিলেন। তাঁর জীবনের চাবি ধরে রাখা ওই লোকটির সঙ্গে মাথা ঠাণ্ডা করে নম্রভাবে কথা না বললে তার কী হবে? তিনি কিভাবে বেঁচে থাকতে পারবেন? কবে তাকে দেশে পাঠানো হবে?

ভুট্টো তার বাঙালি বন্দির সাথে আরো এগারো দিন খেলেছিলেন। . . . ৭ জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত তাঁকে সেখানে একা রেখে লারকানায় তার জন্মদিনের অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর রাতেই ফিরে আসেন। তিনি তখন মুজিবকে প্ররোচিত করে, তাঁকে এবং সমস্ত বাঙালিকে পশ্চিম শাখার সুরক্ষায় ফিরিয়ে নিতে আরও বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন। সেটা কী চমৎকার অভ্যুত্থান হবে! আইয়ুব এবং ইয়াহিয়া যা হারিয়েছিলেন, জুলফিকার আলী ভুট্টো তা পুনরুদ্ধার করবেন। কায়েদ-ই-আওয়াম শহীদ-ত্রাণকর্তা ভুট্টো!

‘২৭ তারিখে আপনি বলেছিলেন যে আমরা দুই বা তিনটি জিনিস একসাথে রাখতে পারি’, ভুট্টো মুজিবকে আবার মনে করিয়ে দিলেন, ‘প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক বিষয় এবং মুদ্রা . . .’।
‘তার আগে আমাকে যেতে দিতে হবে’, মুজিব ঘাবড়ে গিয়ে উত্তর দিলেন।
‘কিন্তু যত শিথিলই হোক কনফেডারেশনের ব্যাপারে আমার আপত্তি নেই’, ভুট্টো ন্যুনতম কিছু প্রতিশ্রুতির জন্য চাপ দিয়ে বললেন।

‘না, না… আমি আগেই বলেছি যে আমরা অপেক্ষা করতে পারি . . . কিছু একটা ব্যবস্থা আমরা করতে পারি। আমি আপনাকে বলেছিলাম এটি একটা কনফেডারেশন হবে। এটা একেবারে আমার এবং আপনার মধ্যে। আমি জানি আপনি কাউকে বলেননি।’

‘না, আমি কেন বলবো’, ভুট্টো বিড়বিড় করে বললো। ‘আমি এটি সম্পূর্ণ গোপন রাখবো।’
‘আপনি এটা আমার ওপর ছেড়ে দিন’, মুজিব জোর দিয়ে বললেন, ‘পুরোপুরি আমার ওপর ছেড়ে দিন। আমাকে বিশ্বাস করুন।’

ভুট্টো বললেন, ‘আমি আপনাকে বিশ্বাস করি।’ তারা একে অপরকে ‘বিশ্বাস’ করেছিল।

‘আমি প্রথমে সেখানে যেয়ে তখন বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষকে এসব কথা বলবো . . . বলবো যে ইয়াহিয়া জনাব ভুট্টোর কাছে দায়িত্ব দেয়ার আগে আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। সেখান যেয়ে আমি ইয়াহিয়ার ফাঁসি দাবি করব। বুঝেছেন- বিচার, বিচার . . . আমি বলবো, ‘আগে এই লোকটার বিচার করো, তারপর তোমার সাথে কথা বলবো’ . . . বুঝেছেন। আমার জনগণকে আস্থায় নিতে হবে। ক্ষতগুলি গুরুতর।’
‘আপনি কাকে বড় ভিলেন মনে করেন- ইয়াহিয়া নাকি পীরজাদা?” ভুট্টো তাকে জিজ্ঞেস করলেন।
‘উভয়ই।’

‘আমি জানি’, ভুট্টো একমত, সন্তুষ্ট, মনে হচ্ছিল তিনি সারারাত বসে কথা বলবেন। তাঁরা তিনজনই এখন তাঁর বন্দি। তিনি একাই রক্ত ও সন্ত্রাসের গত উন্মত্ত বছর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন, কেবল মুক্তই নয়, শীর্ষে, পাকিস্তানের ক্ষমতার শিখরে স্বাচ্ছন্দ্যে সুরক্ষিত। তবু তিনি বাংলাদেশকে ফিরে পাওয়ার জন্য এতটাই উদগ্রীব ছিলেন যে মুজিবকে বললেন, ‘শুনুন, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, আপনি যে পদই নিতে চান নিন, আমি দেশে অবসর নিতে প্রস্তুত। আমি পবিত্র কুরআনের শপথ করে বলছি যে আমি অবসর নিতে প্রস্তুত।’

মুজিব জবাব দিলেন, ‘আমি আপনাকে বলেছি কোনো আপত্তি নেই। ‘আমার ইচ্ছা ছিল আমরা একসাথে থাকব এবং এই দেশকে শাসন করব। হারামজাদা (ইয়াহিয়া) আমাকে বলতে শুরু করলো যে আপনি কী বলেছিলেন . . এবং . . . আপনাকে বললো এক কথা। তখন বাংলায় বিপর্যয় শুরু হয়।

ভুট্টো মনে করিয়ে দিলেন, ‘কিন্তু এখন আমাদের সবকিছু ঠিক করতে হবে।

‘আমাদের চেষ্টা করতে হবে’, মুজিব মানলেন, ‘কিন্তু কোনপথে সেটা আপনি জানেন। আমা্র যেতে হবে এবং মানিয়ে নিতে হবে . . . আপনি জানেন সেখানে দখলদার সেনাবাহিনী আছে . . . আপনাদের সেনাবাহিনী . . . গণহত্যা হয়েছে . . . ইন্দোনেশিয়ার মতো . . . আরেকটি কথা আছে,  আমি আপনাকে খোলাখুলি বলছি . . . পশ্চিম বাংলার মানুষ . . . তাদের বাংলা থেকে বের করে পিষে ফেলতে হবে . . . আমার অসুবিধা আপনি বুঝতে পারেন।’

ভুট্টো স্বীকার করলেন, ‘হ্যাঁ, এটা খুব কঠিন।’ তিনি এখন আবার সরব বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছেন এবং এটি ক্রমেই বাড়তে থাকবে। বিশেষ করে যারা পাকিস্তানের বড় অংশটা খোয়ানোর জন্য তাকে দায়ী করে। ‘আমি ঢাকা যাওয়ার জন্য প্রস্তুত।’

‘না, না’ বঙ্গবন্ধু কিছুটা বিরক্তি ও হতাশায় মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ‘আমি আমার লোকদের সাথে দেখা করব… আমার সময় দরকার . . . সেখানে যেয়ে আপনাকে জানাবো . . . আপনি তো হিরো হয়ে গেছেন। আপনি সারা জীবন চালিয়ে যাবেন।’

ভুট্টো বললেন, ‘না, আমি চাই না।’ ‘আপনারই আমাদের প্রেসিডেন্ট হওয়া উচিত।’ ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে ‘পঞ্চাশ হাজার ডলার’ দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু মুজিব তাঁর কাছ থেকে কোনো টাকা নিতে রাজি হলেন না, ঘাবড়ে গিয়েছিলেন, পরিবর্তে তিনি বলেছিলেন ‘আমার চার্টার্ড প্লেনের ভাড়াটা বরং দিন।’

১৯৭২ সালের 8 জানুয়ারি মধ্যরাতের পর পর শেখ মুজিব বিমানে লন্ডন যান। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে সরাসরি কোনো ফ্লাইট ছিল না এবং তিনি ভুট্টোর প্রস্তাবমত তেহরান বা আঙ্কারার চেয়ে লন্ডন পছন্দ করেছিলেন। পিআইএ-র জেট বিমানটি সেই সকাল সাড়ে ৬টায় ধূসর কুয়াশার মধ্যে হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এবং ভারমুক্ত, শয্যাশায়ী, বাংলাদেশের জাতি-ত্রাতা নায়ক মুজিবুর রহমানকে একটি রোলস রয়েস লিমুজিনে করে শহর কেন্দ্রে মেফেয়ারের অভিজাত ক্লারিজ হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। মুক্তির প্রথম দিনেই দুপুরের আগে তিনি হোটেলের স্যুট থেকে দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধী এবং ডাউনিং স্ট্রিটে প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। হিথ পরের দিন কমনওয়েলথের আরেকটি দেশের প্রধানমন্ত্রীকে দেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাজকীয় বিমান বাহিনীর একটি বিমান ব্যবহারের অনুমতি দেন। মুজিব প্রথমে দিল্লিতে থামেন, সেখানে ইন্দিরা গান্ধী এবং তাঁর পুরো মন্ত্রিসভা বঙ্গবন্ধুকে বীরের প্রাপ্য স্বাগত জানান। ঢাকায় এক সাগর বাঙালি জনতা তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দিকে তাকিয়ে ছিল বহু কষ্টের মধ্যে জন্ম নেয়া দারিদ্র্যপীড়িত শিশু জাতির সমস্ত চাহিদার জবাব পেতে। সেগুলো মোকাবিলার ‘সমস্যা’ বঙ্গবন্ধুর কল্পনাতীত ছিল।

ওপরের অংশ পড়ে প্রশ্ন জাগে শেখ মুজিব ভুট্টোর সঙ্গে এসব কথা কেন বলেছিলেন?
সিডনি শ্যানবার্গ শেখ মুজিবর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের বরাত দিয়ে লিখেছেন, “কয়েকদিন পরে মি ভুট্টো . . . শেখ মুজিবকে দেখতে যান। মুজিব বলেন তিনি ভুট্টোকে স্বাগত জানিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘ভুট্টো, আপনি এখানে কেন?’ শেখ মুজিব বলেন তিনি ভুট্টোর ক্ষমতা গ্রহণের কথা জানতেন কিন্তু তাঁর সঙ্গে ঠাট্টা করছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক’, ভুট্টো জবাব দিয়েছিল। চমৎকার অবস্থা।”

শেখ মুজিব বলেন যে মি. ভুট্টো পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে যত সূক্ষ্মই হোক কোনরকম সম্পর্ক রাখার জন্য আলোচনা শুরু করতে পীড়াপীড়ি করেন।

‘আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম প্রথমে একটা কথা জানতে চাই – আমি কি মুক্ত, না কি না?’ শেখ মুজিব বলেন। ‘আমি মুক্ত হলে আমাকে যেতে দিন। আর না হলে, আমি আলোচনা করতে পারি না।’

তিনি মি. ভুট্টোর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘আপনি মুক্ত কিন্তু আপনাকে যেতে দিতে আরো  কয়েকদিন লাগবে।’

শেখ মুজিব বলেন, ‘মুক্তির অঙ্গীকার করলেও তিনি মি ভুট্টোর সঙ্গে কোনো বাস্তব আলোচনা করেননি।’

ড. কামাল হোসেন লিখেছেন, “. . . তাঁকে ২৬ ডিসেম্বর শিহালায় নেয়া হয়। তিনি আমাকে বললেন, সেখানে পৌঁছার পরপরই ভুট্টো ওই বাংলোয় যান। বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞেস করেন তাঁকেও বন্দি করা হয়েছে কি না। ভুট্টো তখন বলেন যে তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু তখন হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করেন, ‘আমি জাতীয় পরিষদে আপনার চেয়ে দ্বিগুন আসন পেলেও আপনি কী করে প্রেসিডেন্ট হলেন?’ ভুট্টো বিব্রত হয়ে জবাব দিয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধু ইচ্ছে করলে প্রেসিডেন্ট হতে পারেন। বঙ্গবন্ধু জবাব দেন, ‘না, আমি তা চাই না, কিন্তু আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাংলাদেশে যেতে চাই।”

আমাদের বলা হলো কয়েকদিনের মধ্যে আমাদের বিমানে লন্ডন পাঠিয়ে দেয়া হবে; ৭ জানুয়ারি রাতে তারিখ ঠিক হলো। আমাদের জানানো হলো আমাদের যাওয়ার আগে ভুট্টো প্রেসিডেন্টের অতিথি ভবনে আমাদের নৈশভোজ দেবেন, আমাদের গাড়িতে শিহালা থেকে নিয়ে যাওয়া হবে এবং নৈশভোজের পর সেখান থেকে সরাসরি বিমানে উঠিয়ে দেয়া হবে। ভুট্টো এলেন, এবং প্রাথমিক সৌজন্য বিনিময়ের পর তিনি বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার অনুরোধ করেন। বঙ্গবন্ধু জবাব দেন, ‘যতকিছু ঘটেছে, যত রক্ত ঝরেছে, যা আমাদের কথা শুনলে সহজেই এড়ানো যেত। তা না করে আপনারা নৃশংস সশস্ত্র হামলা চালালেন। আমি জানি না দুটো সার্বভৌম (দেশের) মধ্যে সম্পর্কের মতো না হলে আর কিভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা যাবে।’

১৯৭১ সালে ঢাকায় মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার কে ব্লাড ‘দা ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ’ বইয়ে লিখেছেন, ‘২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে বৈরুতে টাইম লাইফ সংবাদদাতা ড্যান কগিন আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। আগের দিন বিকেলে তিনি মুজিবের সঙ্গে ঘণ্টাখানেক আলাপ করেন। তখন মুজিব তাঁকে আমাকে বাজিয়ে দেখতে বলেন যে, ৬ দফার ভিত্তিতে সংবিধান মেনে নেয়ার জন্য ইয়াহিয়ার ওপর প্রভাব খাটাতে আমেরিকা রাজি হবে কি না। অথবা সে ব্যাপারে কোনো সমঝোতা না হলে দুই প্রদেশের জন্য আলাদা সংবিধান গ্রহণ করতে ইয়াহিয়া এবং সামরিক বাহিনিকে সম্মত করাতে পারবে কি না। আমি সেটা একজন সীমিত ক্ষমতার প্রেসিডেন্টের অধীনে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের একটি কনফেডারেশন মনে করেছিলাম।’

খ্যাতনামা সাংবাদিক এ্যান্থনি মাসকারেনাস দাবি করেন, ‘আমি ঠাট্টা করে মুজিবকে বলতাম যে আমি তাঁকে তাঁর স্ত্রীর চেয়ে ভালো করে চিনি।’ শেখ মুজিবের মুক্তির পর লন্ডন গেলে সেখানে মাসকারেনাসও ছিলেন। তিনি তাঁর ‘বাংলাদেশ এ লেগেসি অব ব্লাড’ বইয়ে লিখেছেন, ‘এখন লন্ডনে আবার আমাদের বন্ধুদের/পেশাজীবীদের দেখা হলো, মুজিব তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ খেলাটি শুরু করতে যাচ্ছেন। আমরা কথা বলছিলাম, তিনি যখন অন্যদের সঙ্গে কথা বলছিলেন আমি পাশে বসে শুনছিলাম। আমি যখন আমার লেখাটা তৈরি করার জন্য উঠলাম তখন আমি বিচলিত ছিলাম যে শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধু, প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশের অশ্বারোহী সেনানী, নেতৃত্ব নেয়ার আগমুহুর্তেও যার সামান্য ধারণা নেই জিনিসটা কী।

আরো কী, তিনি গোপনে জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে সম্ভাব্য চুক্তির আশা পোষণ করছেন, যাতে পাকিস্তান এবং তার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া প্রদেশের মধ্যে একটা যোগসূত্র থাকে।
বাংলাদেশের মানুষের মনোভাবের পুরো উল্টো ওই বিরক্তিকর চুক্তির কিছুটা ধারণা পেয়েছিলাম মুজিব যখন আমাকে চুপিসারে কথাটি বলেন, ‘তোকে একটা টাটকা খবর দিতে পারি। আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে একটা যোগসূত্র রাখবো। কিন্তু এ বিষয়ে অন্যদের সঙ্গে কথা না বলে এখন আর কিছু বলতে পারছি না। খোদার কসম, আমি না বলা পর্যন্ত এটা নিয়ে কিছু লিখবি না।’

‘যোগসূত্রটা ঠিক কী ছিল, মুজিব আমাকে তা বলেনি। কিন্তু ওটা শুনে আমার নিজের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আতঙ্কিত হয়েছিলাম।’ আমি বললাম, ‘তুমি কি পাগল হয়েছ? জানো না বাংলাদেশে কী ঘটেছে? মানুষ যে অবস্থার মধ্যে কাটিয়েছে তাতে তুমি বঙ্গবন্ধু হও আর না হও যোগসূত্র নিয়ে একটা কথা বললে ঢাকার রাস্তায় লোকে তোমাকে পেটাবে।’

লেখক: কাজী জাওয়াদ, সাংবাদিক ও লেখক

About Syed Enamul Huq

Leave a Reply