Tuesday , 21 January 2025
E- mail: news@dainiksakalbela.com/ sakalbela1997@gmail.com
ব্রেকিং নিউজ
সংখ্যালঘু ইস্যু সরকার কতটা সামাল দিতে পারছে
--সংগৃহীত ছবি

সংখ্যালঘু ইস্যু সরকার কতটা সামাল দিতে পারছে

অনলাইন ডেস্কঃ
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ এবং এরপর সনাতন জাগরণের মঞ্চের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারকে কেন্দ্র করে প্রতিবেশী ভারতের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কে দৃশ্যত অবনতি ঘটেছে।এর জের ধরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বিবৃতি, সামাজিক মাধ্যমে পতাকা অবমাননার ছবি প্রচারসহ বাংলাদেশ ও ভারতে পরস্পরবিরোধী আগ্রাসী প্রচারণা, কলকাতায় বাংলাদেশ উপহাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ-হুমকির অভিযোগ উঠে আসছে।

ভারতীয় গণমাধ্যমে অপতথ্য প্রচারের ঘটনায় জাতিসংঘের সংখ্যালঘু বিষয়ক ফোরামে বাংলাদেশ বলেছে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন নিয়ে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে এবং দেশের সংখ্যালঘুদের ওপর পদ্ধতিগত কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি।

পরিস্থিতি কীভাবে এতদূর গড়ালো

বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় একজন ব্যক্তি বলেছেন, স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিভিন্ন সময়ে আক্রমণের শিকার হয়েছে এবং প্রতিটি সরকারের আমলেই ধারাবাহিকভাবে তা চলে আসছে।

‘এবার জুলাইয়ের শুরু থেকেই দেশের নানা জায়গায় বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটছিলো, যা এখনো চলছে। তবে দুর্গাপূজার সময় ব্যাপক উদ্বেগ তৈরি হলেও রাষ্ট্র তা সামাল দিয়েছে। চট্টগ্রামে আইনজীবী হত্যার পরেও রাষ্ট্র ও সরকার পরিস্থিতির অবনতি ঠেকাতে পেরেছে। অর্থাৎ সরকার চাইলে এটি সম্ভব।
গণআন্দোলনের মুখে ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ অগাস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়েছিলো। সরকার বিহীন এই তিনদিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও তাদের বিভিন্ন স্থাপনার ওপর হামলার অভিযোগ ওঠে।
পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারেও ‘সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও ভাংচুরের নিন্দা জানিয়ে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ মিছিল’ করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।১৩ আগস্ট মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তার বাসভবনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতাদের সাথে বৈঠক করেন, যেখানে ইসকন, পূজা উদযাপন পরিষদ ও ঐক্য পরিষদের প্রতিনিধিরাও ছিলেন।প্রধান উপদেষ্টা পরে দুর্গাপূজার সময় কঠোর নিরাপত্তার পাশাপাশি মন্দির ও উপাসনালয়গুলোতে মাদ্রাসা ছাত্রদের পাহাড়া দেওয়ার ছবিও আলোচিত হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে। তবে পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে সনাতনী জাগরণ মঞ্চ দেশজুড়ে সমাবেশ শুরুর পর।

গত ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে সমাবেশের আয়োজন করে সনাতন জাগরণ মঞ্চ এবং সেই সমাবেশে প্রধান বক্তা ছিলেন চিন্ময় কৃষ্ণ দাস, যিনি এখন রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় আটক হয়ে কারাগারে আছেন।ওই সমাবেশ থেকে আট দফা জানানো হয়। তার মধ্যে আছে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সংখ্যালঘু নির্যাতনে জড়িতদের উপযুক্ত শাস্তি, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন এবং অবিলম্বে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা।সমাবেশে দেওয়া ভাষণে চিন্ময় দাস বলেছিলেন, ‘কেউ যদি আমাদের উৎখাত করে শান্তিতে থাকার চেষ্টা করেন, তাহলে এ ভূমি আফগানিস্তান হবে, সিরিয়া হবে। শুধু সংখ্যালঘু পরিচয়ে ৯৩ জনকে পুলিশের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ভেটেরিনারি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দুদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। মাঝখানে কিছুদিন এমন অপকর্ম থেমে গিয়েছিল। এখন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠছে। আমরা আর নীরব থাকব না।’

লালদীঘির সমাবেশের ছবি ও তার বক্তব্য সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। এরপর একই দাবিতে তিনি রংপুরেও সমাবেশ করেন।

কিন্তু এর মধ্যেই আলোচনায় উঠে আসে ইসকন প্রসঙ্গ। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে চট্টগ্রাম নগরীর টেরিবাজার এলাকায় হিন্দু অধ্যুষিত হাজারী গলিতে ‘ইসকন নিয়ে ফেসবুকে দেওয়া পোস্ট’কে কেন্দ্র করে অন্তত ৮২ জনকে আটক করে পুলিশ। এ ঘটনায় ওই এলাকায় যৌথবাহিনী ব্যাপক অভিযান চালায়, যাতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা।

এর আগে ইসকন সংবাদ সম্মেলন করে তাদের নিয়ে ‘অসত্য’ বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগ করে আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের তীব্র সমালোচনা করেছে।

মাহমুদুর রহমান এক অনুষ্ঠানে ‘ইসকনকে সাম্প্রদায়িক ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র-এর’ সংগঠন হিসেবে মন্তব্য করেছিলেন। তখন ইসকন এক বিবৃতিতে বলেছে এটি একটি অরাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ ধর্মীয় সংগঠন।

কিন্তু সনাতনী জাগরণ মঞ্চের চট্টগ্রাম ও রংপুরের সমাবেশের পর চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ইসকন নেতা বলে প্রচার শুরু হয় সামাজিক মাধ্যমে। কেউ কেউ ‘ইসকনকে নিষিদ্ধ করার’ দাবি জানাতে থাকেন। তবে ইসকন জানিয়েছে যে চিন্ময় দাস ও সনাতনী জাগরণ মঞ্চের সাথে ইসকনের কোনো সম্পর্ক নেই।

এমন পরিস্থিতিতে সোমবার ঢাকা থেকে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। পরদিন তাকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে উপস্থাপন করা হয়। এ সময় তার অনেক অনুসারী সেখানে জমায়েত হন। এ নিয়ে সংঘর্ষ হয় সেখানে। সংঘর্ষ চলাকালে আদালতের মূল ফটকের উল্টো দিকের এক গলিতে আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে হত্যা করে চিন্ময়ের অনুসারীরা।

এ ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ভারত। পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখায় বাংলাদেশও। উভয় দেশের সামাজিক মাধ্যমে পরস্পরবিরোধী ব্যাপক প্রচারণা শুরু হয়।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে প্রভাব

চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারের পর ভারতের হিন্দুত্ববাদী দলগুলো বেশ আগ্রাসী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে শুরু করে। বাংলাদেশেও শুরু হয় ইসকন ও ভারত বিরোধী প্রচারণা। বিবৃতি আসে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও।

ভারতের উদ্বেগ প্রকাশের পাল্টা বিবৃতিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছে, ‘চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে নির্দিষ্ট অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর থেকে কিছু মহল তা নিয়ে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিচ্ছে। এমন অপ্রমাণিত বিবৃতি শুধু সত্যের অপলাপই নয়, একই সঙ্গে তা দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও বোঝাপড়ার চেতনার পরিপন্থী।’

এরপর বৃহস্পতিবার কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনের সামনে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হলে তার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেয় বাংলাদেশ সরকার।

শুক্রবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়েও উঠে আসে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, ‘আমাদের অবস্থান খুব স্পষ্ট। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই সব সংখ্যালঘুর নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে হবে।’

বাংলাদেশেও সরকারের কয়েক উপদেষ্টা ভারতকে ইঙ্গিত করে নানা ধরনের মন্তব্য করেছেন।

আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পাতায় লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের অযাচিত উদ্বেগ প্রকাশ থেমে নেই। ভারতের নিজেদের মাটিতে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর অসংখ্য নির্মমতার ঘটনা ঘটে চলেছে। অথচ সেটা নিয়ে তাদের সংকোচ বা অনুশোচনা নেই। ভারতের এই দ্বিচারিতা নিন্দনীয় ও আপত্তিকর।’

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দেওয়াকে ভারতের “অনধিকার চর্চা” বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘তারা (ভারত) ঘটনাকে আরো উস্কে দেয়ার চেষ্টা করছে।’

সরকার সামাল দিতে পারছে?

ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে এক সেমিনারে আজ শনিবার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, ‘বাংলাদেশের উদ্বেগগুলো ভারত গুরুত্ব দিলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হতো না। ভারতীয় গণমাধ্যমের ভূমিকাও দুদেশের স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় সহায়ক নয়।’

অন্যদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাব্বির আহমেদ বলছেন, ‘সংখ্যালঘুদের সাথে আলোচনায় বসে সরকার তাদের কথা শুনতে পারতো এবং আলোচনা করেই সরকার সমাধানের উদ্যোগ নিতে পারতো। ইসকন ইস্যু তো বেশিদিন শোনা যায়নি। সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে। ইসকন গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হবে যদি এটা ভালো করে হ্যান্ডল করা না যায়। দেখতে হবে যে তারা কী ধর্মীয় শক্তি? ধর্মীয় হলে তো সমস্যা নেই। কিন্তু ধর্মীয় সংগঠন রাজনৈতিক ভূমিকা নিলে সন্দেহ দানা বাধতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘ভারতের বিজেপি হিন্দুত্ববাদী দল এবং সে কারণেই তারা বারবার কথা বলবে। তবে দেখতে হবে এটাকে কেন্দ্র করে ভারতের সাথে সম্পর্ক যেন তলানিতে না যায়। এ ইস্যুতে ভারতের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হলে আমরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবো। সেজন্য আমাদের দিক থেকে যেন সরকারের উদ্যোগ ও স্বচ্ছতার কোনো অভাব না থাকে।’

About Syed Enamul Huq

Leave a Reply