একটি রাষ্ট্রের কিছু প্রতিষ্ঠান থাকে, যে প্রতিষ্ঠান দেশের ঐক্য ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। দেশের অখন্ডতা এবং স্বাধীনতার রক্ষাকবচ। এ রকম একটি প্রতিষ্ঠান হলো সশস্ত্র বাহিনী। বিশ্বের সব রাষ্ট্রেই সশস্ত্র বাহিনীকে সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা হয়।
এক. জুলাই বিপ্লবের পর সারা দেশে যখন মব সন্ত্রাস চলছিল, বিভিন্ন জায়গায় হামলা যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছিল, মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছিল; এ রকম একটি নাজুক সময় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি সামাল দেন। গত বছরের আগস্টে এ রকম একটি ঘটনা আমরা দেখেছি শাহবাগ থানায়। যৌন হয়রানির অভিযোগে এক যুবককে মারতে মারতে কিছু তরুণ-তরুণী শাহবাগ থানায় হাজির হয়। তখন সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেনের সঙ্গে এক তরুণীর বাগ্বিতন্ডা হয়। যা পরে সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে দেখা যায়, ওই তরুণী উত্তেজিত হয়ে বাগ্বিতন্ডা করলেও সেনাসদস্য ক্যাপ্টেন আশিক অত্যন্ত বিচক্ষণতা ও ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দেন এবং এর সমাধান করেন। ক্যাপ্টেন আশিকের এ ধৈর্য ও পেশাদারি দেখে নেটিজেনরা প্রশংসা করেন। পরে ১৮ আগস্ট সেনাপ্রধানের কার্যালয়ে সাক্ষাতে ক্যাপ্টেন আশিককে সাধুবাদ জানান সেনাপ্রধান। তাকে ভবিষ্যতের জন্যও অনুপ্রাণিত করেন তিনি। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার মহামারি প্রতিরোধে এ ঘটনাটি একটি মাইলফলক।
দুই. গত বছর সেপ্টেম্বরে দেশের দক্ষিণাঞ্চল যখন বন্যাকবলিত, তখন উদ্ধারকাজে নিয়োজিত হয় সশস্ত্র বাহিনী। এ সময় একজন সেনাসদস্যের ভূমিকাও সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্যাপক প্রশংসা করেন নেটিজনেরা। চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে বন্যাদুর্গতদের উদ্ধার করতে গিয়ে নিজের হাঁটু সিঁড়ি বানিয়ে অসুস্থ ও গর্ভবতী নারীদের ট্রাকে উঠতে সহায়তা করে মানবিক সেবার অনন্য নজির স্থাপন করেছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ল্যান্স করপোরাল (গানার) কাজী সুজন। অনেকেই সেনাসদস্য সুজনকে ‘সুপারহিরো’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
তিন. মাগুরায় আট বছরের শিশুর সঙ্গে ঘটে যাওয়া পাশবিকতা সামনে আসার পর ধর্ষণ-যৌন নিপীড়নের বিচার দাবিতে সারা দেশ যখন উত্তাল তখনো সেই নির্যাতিত শিশুর পাশে দাঁড়িয়েছিল আমাদের সশস্ত্র বাহিনী। উন্নত চিকিৎসার জন্য সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয় তাকে। শিশু আছিয়া যখন জীবনমরণ সন্ধিক্ষণে তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে দেশবাসীর কাছে শিশুটির জন্য প্রার্থনার আহ্বান জানানো হয়। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এক অনন্য মানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। তবে দুঃখের বিষয়, শেষ পর্যন্ত শিশু আছিয়া মৃত্যুর কাছে হেরে যায়। এ সময়ও পাশে দাঁড়িয়েছিল সশস্ত্র বাহিনী। তারা শিশুটির লাশ অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে গ্রামের বাড়ি মাগুরায় পৌঁছে দেয়।
চার. ৫ আগস্টের গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা একটি নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। আর এর পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান আছে জুলাই বিপ্লবে আহতদের। যারা একটি স্বৈরাচারের পতনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং স্বৈরাচার সরকার কর্তৃক তারা বিভিন্নভাবে আহত হয়েছেন। তাদের পাশেও দাঁড়িয়েছে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী। ২৩ মার্চ জুলাই অভ্যুত্থানে আহত শিক্ষার্থীদের সম্মানে এক ইফতার আয়োজন করেন সেনাপ্রধান। সেখানে জুলাই অভ্যুত্থানে আহত শিক্ষার্থীদের পাশে থাকার ঘোষণা দেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। এভাবে প্রতিটি ক্রান্তিকালে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
পাঁচ. গত এপ্রিলে সমাজমাধ্যমে আলোচিত হয় আরেক ভিডিও। যেখানে দেখা গেছে শিক্ষার্থীদের অবরোধে কথা বলতে গিয়ে রীতিমতো অপমানিত হয়েছেন এক ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা। তার সঙ্গে অসদাচরণ করেন রাস্তা অবরোধ করা শিক্ষার্থীরা। তবে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদমর্যাদার ওই কর্মকর্তাকে দেখা গেছে ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি সামাল দিতে; যা গোটা দেশে ব্যাপক প্রশংসিত হয়। এভাবেই বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতি বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের ধৈর্য ধরে মোকাবিলা করতে দেখা যাচ্ছে। ১০ মাস ধরে এভাবে ধৈর্য, সাহস এবং মানবিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে কাজ করে যাচ্ছে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী। মানুষের পাশে, ভালোবেসে।
এ রকম অনেক ঘটনাই আছে। বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক পথে উত্তরণের জন্য সশস্ত্র বাহিনী যে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে, সেই সশস্ত্র বাহিনীকে আমাদের সম্মান করতে হবে এবং তাদের সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে তারাই আমাদের অস্তিত্ব এবং সার্বভৌমত্বের প্রতীক। সশস্ত্র বাহিনীকে বিতর্কিত করলে আমাদের শেষ আস্থার জায়গাটুকুও বিতর্কিত হবে। এ রকম পরিস্থিতি কারও কাম্য নয়। এজন্য সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা উচিত। এ বিষয়টি নিয়ে দায়িত্বশীল আচরণ করা উচিত বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।