Friday , 19 April 2024
E- mail: news@dainiksakalbela.com/ sakalbela1997@gmail.com
ব্রেকিং নিউজ
২১ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে নেতৃত্বশূন্য করার  জঘন্যতম অপচেষ্টার দিন  # সেদিন যা ঘটেছিল, যেভাবে ঘটেছিল
--ফাইল ছবি

২১ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে নেতৃত্বশূন্য করার  জঘন্যতম অপচেষ্টার দিন # সেদিন যা ঘটেছিল, যেভাবে ঘটেছিল

☆ জেমস আব্দুর রহিম রানা ☆

আজ ২১ আগস্ট—বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি ভয়াবহ কলঙ্কময় দিন। দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে নেতৃত্বশূন্য করার  জঘন্যতম অপচেষ্টার দিন। বাঙালি জাতির জীবনে আরেক মর্মন্তুদ অধ্যায় রচনার দিন। ২০০৪ সালের এই দিনে আজকের প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে গ্রেনেড ছুড়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়। নেতাকর্মীরা মানবঢাল তৈরি করে তাকে বাঁচাতে পারলেও মহিলা লীগের তৎকালীন সভাপতি আইভী রহমান, শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত দেহরক্ষীসহ ২৪ জন নেতাকর্মী এই ভয়াবহ, নৃশংস, নিষ্ঠুর-নির্মম গ্রেনেড হামলায় মারা যান। সেদিন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রাণে বেঁচে গেলেও তার দুই কান ও চোখ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অপূরণীয় ক্ষতি হয় তার শ্রবণশক্তির। অলৌকিকভাবে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসেন তিনি।
বতর্মান প্রধানমন্ত্রী, মানবতার জননী শেখ হাসিনা তখন আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন। বিএনপি সরকারের সন্ত্রাস-দুর্নীতিবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে সেদিন বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল। একটি ট্রাকে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করে সমাবেশ চলছিল। সেদিনের অভিশপ্ত ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শেখ হাসিনা বিকাল পাঁচটার দিকে সমাবেশস্থলে পৌঁছান। বুলেটপ্রুফ গাড়ি থেকে নেমে নিরাপত্তাকর্মী ও দলীয় নেতাকর্মী পরিবেষ্টিত অবস্থায় তিনি অস্থায়ী মঞ্চে ওঠেন।
সমাবেশে শেখ হাসিনা বক্তব্য শুরু করেন ৫টা ২ মিনিটে। ২০ মিনিটের বক্তব্য শেষে ৫টা ২২ মিনিটে ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে হাতে থাকা একটি কাগজ ভাঁজ করতে করতে মাইক ছেড়ে পিছিয়ে যাচ্ছিলেন। ঠিক সেই সময় একজন সাংবাদিক তাকে ছবির জন্য একটি পোজ দিতে অনুরোধ করেন। তখন শেখ হাসিনা আবারও  ঘুরে দাঁড়ান। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই দক্ষিণ দিক থেকে তাকে লক্ষ্য করে একটি গ্রেনেড ছুড়ে মারা হয়। গ্রেনেডটি ট্রাকের বাঁ পাশে পড়ে বিস্ফোরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শেখ হাসিনা ট্রাকের ওপর বসে পড়েন। তার সঙ্গে থাকা অন্য নেতারা এ সময় মানবঢাল তৈরি করে তাকে ঘিরে ফেলেন। প্রথম গ্রেনেড হামলার মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ট্রাক লক্ষ্য করে একই দিক থেকে পর পর আরও দুটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। বিকাল ৫টা ২২ মিনিট থেকে এক-দেড় মিনিটের ব্যবধানে ১৩টি গ্রেনেডের বিকট বিস্ফোরণ ঘটে। তখন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি প্রয়াত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ও সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, নিরাপত্তা কর্মকর্তা মেজর (অব.) শোয়েব, ব্যক্তিগত স্টাফ নজীব আহমেদসহ দেহরক্ষীরা শেখ হাসিনাকে ধরে ট্রাক থেকে দ্রুত নামিয়ে তার মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িতে তুলে দেন।

জানা যায়, সিনিয়র ফটোসাংবাদিক এস এম গোর্কি সেদিন শেখ হাসিনার ভালো ছবি পাননি বলে তাকে আবারও পোজ দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। তার অনুরোধে সাড়া দিয়েই সাংবাদিক বান্ধব বঙ্গবন্ধুকন্যা ফের ডায়াসে ঘুরে দাঁড়ান। এ বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার একাধিক বক্তব্যে নিজেই উল্লেখ করেছেন। এই প্রতিবেদক উপস্থিত ছিলেন এমন একটি অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে (২০০৯ সালে দৈনিক পূর্বঞ্চল পত্রিকার ঢাকা অফিসে কর্মরত থাকাকালীন ) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘নেতাকর্মীরা মানবঢাল তৈরি করে আমাকে বাঁচিয়েছেন। কিন্তু গ্রেনেড গায়ে লাগলে কী হতো বলা যায় না।’ তিনি ফটোসাংবাদিক এস এম গোর্কির নাম উল্লেখ করে বলেন, ‘গোর্কি মনে হয় ভালো ছবি পায় নাই। আমি বক্তব্য শেষ করে যাওয়ার জন্য ঘুরে এক পা বাড়িয়েছি। তখন গোর্কি আমাকে বলে, ‘আপা, ছবি পাই নাই, একটু দাঁড়ান।’ আমি আবারও ঘুরে দাঁড়াই। আর সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দ। গ্রেনেড যে জায়গায় পড়েছে সেদিক দিয়েই আমার নামার কথা ছিল। কিন্তু ছবি তোলার সুযোগ দিতে ঘুরে দাঁড়ানোয় আমি আবারও ডায়াসে দাঁড়াই।’

এস এম গোর্কির কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভালো ছবি না পাওয়ায় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতাকে একটু সময় দেওয়ার অনুরোধ করেছিলাম। তিনি অনুরোধে সাড়া দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন। তখনই গ্রেনেড ফুটতে শুরু করে। ’

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রথম দফায় হামলার পর স্টেডিয়ামের দিক হয়ে ঘটনাস্থল থেকে দ্রুত শেখ হাসিনাকে সরিয়ে নেওয়া হয়। ঘটনাস্থলে উপস্থিত আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘দলীয় সভাপতি যখন ঘটনাস্থল ত্যাগ করছিলেন, তখনও একই দিক থেকে কয়েক সেকেন্ড বিরতি দিয়ে গ্রেনেড এসে ঘটনাস্থলে বিস্ফোরিত হতে থাকে। একইসঙ্গে চলছিল তার গাড়ি লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ। এসব গুলি ও গ্রেনেড ঠিক কোথা থেকে ছোড়া হচ্ছিল, তা বোঝা না গেলেও বেশ পরিকল্পিতভাবে যে হামলা হয়েছে, তা পরে বোঝা যায়। তার (শেখ হাসিনা) বাসভবন ধানমন্ডির সুধা সদনে গিয়ে তাকে বহনকারী মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িটির সামনে-পেছনে গ্রেনেড ও গুলির আঘাতের  অসংখ্য চিহ্ন দেখতে পাই আমরা।’’

উদ্ধারকর্মীর বক্তব্য

গ্রেনেড হামলার পর সেদিন উদ্ধার কাজে অংশ নেওয়া ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও পুনর্বাসন সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বলেন, ঘটনার সময় ওই এলাকাটি যেন ‘কারবালা প্রান্তর’ হয়ে পড়েছিল । বিস্ফোরণের শব্দ, আহতদের চিৎকার-আহাজারি, রক্তাক্ত নেতাকর্মীদের ছুটোছুটিতে পুরো এলাকা বিভীষিকাময় হয়ে ওঠে। চারদিকে ছোপ ছোপ রক্ত আর মানুষের ছিন্নভিন্ন দেহ। বিচ্ছিন্নভাবে পড়েছিল পায়ের জুতা, সেগুলো ছিল রক্তে লাল।’ তিনি বলেন, ‘দলের সভাপতি আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সরিয়ে নেওয়ার পর ট্রাক থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় নামতে থাকেন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা। যারা অচেতন হয়ে পড়েছিলেন, তাদের ধরে নামানো হয়। কী ঘটছে কিছুই বুঝতে না পেরে অনেক নেতাকর্মী এ সময় ছুটে দলীয় কার্যালয়ের ভেতরে যান। আহতদের মধ্যেও অনেককে ধরে ভেতরে নেওয়া হয়। অনেককে দেখা যায়, পথে রক্তাক্ত অবস্থায় ছুটোছুটি করতে। গ্রেনেড বিস্ফোরণের ঘটনায় এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, আহতদের হাসপাতালে পাঠাতে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় দলীয় নেতাকর্মীদের। এ অবস্থায়ই রিকশা, অ্যাম্বুলেন্স, প্রাইভেটকার, বেবিট্যাক্সি, এমনকি রিকশা ভ্যানে করেও আহতদের প্রথমে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। এ সময় অনেককে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে থেকে সাহায্যের জন্য আকুতি জানাতে দেখা যায়।’ দলীয় নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ আহদের সহায়তা ও হাসপাতালে নেওয়ার কাজে এগিয়ে এলেও পুলিশ সাহায্য করেনি বলে  অভিযোগ করেন শহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘সেদিন ঘটনাস্থলের দায়িত্ব থাকা অন্যতম পুলিশ কর্মকর্তা সালাউদ্দিনকে সাহায্য করার অনুরোধ জানালেও তিনি সাড়া দেননি।’

পুলিশের কাঁদানে গ্যাস-লাঠিপেটা

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিস্ফোরণের প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠে আওয়ামী লীগ কর্মীরা সেদিন ক্ষোভে ফেটে পড়েন। বিক্ষুব্ধ কর্মীরা রাস্তায় বিক্ষোভ শুরু করেন। এদিকে ঘটনার পর সকল প্রকার যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অনেক স্থানে আগুন জ্বলতে দেখা যায়। তখন পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে বিক্ষুব্ধ কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করতে থাকে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় আহত স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক গণযোগাযোগ বিষয়ক সহ-সম্পাদক আনোয়ার পারভেজ টিংকু বলেন, ‘আহতদের হাসপাতালে নিতে পুলিশ সাহায্য করেনি, উল্টো বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের নির্বিচারে লাঠিপেটা করে এবং টিয়ার গ্যাস ছোড়ে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাকে কীভাবে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে বা কারা নিয়েছিল সেটা অনেক পরে জেনেছি। কারণ, আমার শরীরে গ্রেনেডের আঘাত লাগায় রক্তাক্ত হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম।’

সমাবেশস্থলে করুণ আহাজারি

ঘটনার পরপরই ওই স্থানে যাওয়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সাংবাদিক জানান, তিনি গিয়ে দেখতে পান – চারদিকে যানবাহনে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। রাস্তায় পড়ে আছে জমাটবাঁধা রক্ত, হতাহতদের শরীর থেকে বের হয়ে যাওয়া নাড়িভুঁড়ি, রক্তাক্ত দলীয় পতাকা-ব্যানার, আর পরিত্যক্ত অসংখ্য জুতা- স্যান্ডেল। দলীয় কার্যালয়ের সামনে পেট্রোল পাম্পের গলির মাথায় পড়ে আছে একটি তরতাজা গ্রেনেড, অদূরে আরেকটি। আহতদের দলীয় কার্যালয়ের ভেতর থেকে বের করে ভ্যানে ওঠানো হচ্ছিল। পাশের আরেকটি দোকান থেকে বের করে গাড়িতে ওঠানো হচ্ছিল আহত আরও কয়েকজনকে। উদ্ধারকারীরাও আহতদের শরীর থেকে বের হওয়া রক্তে ভিজে একাকার। ফলে পাশে দাঁড়িয়ে থেকেও ঠিক শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছিল না কে আহত আর কে উদ্ধারকর্মী। আহতদের চিৎকার, উদ্ধারকর্মীদের হৈচৈ, বিক্ষোভকারীদের স্লোগানের শব্দে একাকার হয়ে যাচ্ছিল অ্যাম্বুলেন্স আর পুলিশের গাড়ির সাইরেনের শব্দ। ওই প্রত্যক্ষদর্শী আরও  জানান, উদ্ধার অভিযান চলাকালে সন্ধ্যা ৬টা ২৬ মিনিটে প্রচণ্ড শব্দে আরেকটি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়, পুলিশের উপস্থিতিতেই সিটি ভবনের পাশের গলিতে। সভার মঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত ট্রাকের ওপর, এর পাশে, সমাবেশস্থলে এসব বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের পর পর ধোঁয়ার কুণ্ডলী, মানুষের চিৎকার, ছুটোছুটিতে প্রাণবন্ত একটি সমাবেশের চেহারাই পাল্টে যায়। আওয়ামী লীগ কার্যালয় আর রমনা ভবনের সড়কে বিভিন্ন জায়গা ভেসে যেতে থাকে রক্তের স্রোতে। ছেঁড়া স্যান্ডেল, রক্ত, পড়ে থাকা ব্যানার, পতাকার সঙ্গে এখানে-সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছিল নারী-পুরুষের দেহ। কেউ নিথর-স্তব্ধ, কেউবা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন।

সেদিনই ১৬ জন মারা যান। পরে আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ আরও কয়েকজন মিলিয়ে ওই হামলার ঘটনায় মোট ২৪ জন নিহত হন। শেখ হাসিনাসহ  দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই আহত হন।

শেখ হাসিনাকে হত্যার সব চেষ্টাই হয়

গ্রেনেড হামলা থেকে কোনোভাবে বেঁচে গেলেও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা যেন প্রাণ নিয়ে ফিরতে না পারেন, তার সব চেষ্টায়ই করেছিল হামলাকারীরা। তার গাড়ির কাচে কমপক্ষে সাতটি বুলেটের আঘাতের দাগ, গ্রেনেড ছুড়ে মারার চিহ্ন এবং বুলেটের আঘাতে পাংচার হয়ে যাওয়া গাড়ির দুটি চাকা সে কথাই প্রমাণ করে। এটি ছিল একেবারে ঠান্ডামাথায় হত্যার পরিকল্পনা। তিন স্তরের বুলেট নিরোধক ব্যবস্থাসম্পন্ন মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িটিই সেদিন শেখ হাসিনার প্রাণ বাঁচিয়েছে বলে তার তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব সাবের হোসেন চৌধুরী সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন। সেদিন তিনি বলেছিলেন, গ্রেনেড আক্রমণ ব্যর্থ হলে নেত্রীকে হত্যার বিকল্প পন্থা হিসেবে বন্দুকধারীদের তৈরি রাখা হয়। আর এই বন্দুকধারীরাই খুব হিসাব কষে নেত্রীর গাড়ির কাচে গুলি চালায়। এই গুলি বুলেটপ্রুফ কাচ ভেদ করতে ব্যর্থ হলে তারা গাড়ি লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুড়ে মারে। কিন্তু এই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। সব শেষে গাড়ির চাকা লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে থামানোর চেষ্টা করা হয়। এ অবস্থায় গুলির আঘাতে গাড়ির বাঁ পাশের সামনের ও পেছনের দুটি চাকা পুরোপুরি পাংচার হয়ে গেলেও চালক অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সেই গাড়িটি বঙ্গবন্ধু এভিনিউর দলীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে ধানমন্ডির সুধা সদনে নিয়ে যান।

সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘গ্রেনেড হামলার পরপরই শেখ হাসিনার নিরাপত্তাকর্মীরা তাকে ঘেরাও করে নামিয়ে গাড়ির কাছে নিয়ে আসেন। আর তখনই গাড়ির সামনের জানালা লক্ষ্য করে পর পর অনেকগুলো গুলি ছোড়া হয়। এ সময় তাকে ঘেরাও করে রাখা আওয়ামী সভাপতির ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী মাহবুব স্পটেই মারা যান। কোনোক্রমে শেখ হাসিনা গাড়িতে ওঠার পরপরই গাড়ি চালু করতেই পেছন থেকে বাঁ দিকের সিট লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছোড়া হয়। কোনোরকমে জীবন নিয়ে তার বাসভবন সুধা সদনে বেঁচে ফেরেন শেখ হাসিনা।’

বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পরপরই ধানমন্ডির ৫ নম্বর সড়কে শেখ হাসিনার বাসভবন সুধা সদনে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ধীরে ধীরে সেখানে জড়ো হতে থাকেন বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা। সন্ধ্যা ৬টার দিকে শেখ হাসিনা সুধা সদনে এসে পৌঁছান। এর পরপরই সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে আসেন যথাক্রমে তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল, আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ, মতিয়া চৌধুরীসহ আওয়ামী লীগের অন্য নেতারা। সেদিন সেখানে উপস্থিত থাকা আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগরের নেতা আব্দুল হক সবুজ বলেন, ‘‘সুধা সদনের সামনে উপস্থিত দলীয় নেতাকর্মীদের একটাই জানার ছিল— ‘নেত্রী কেমন আছেন’? সবাই শুধু এটাই জানার চেষ্টা করছিলেন—নেত্রী ঠিক আছেন তো।’’

পূর্ণ হয়ে যায় হাসপাতালগুলো

এদিকে ঘটনার পর আহতদের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে রাজধানীর হাসপাতালগুলো। নেতাকর্মী আর স্বজনদের ভিড়ে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে রাজধানীর অধিকাংশ হাসপাতাল। আহতদের আর্তচিৎকার আর স্বজনদের গগনবিদারী আর্তনাদে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে সেখানকার পরিবেশ। আতঙ্ক আর অবিশ্বাস নিয়ে এদিক-ওদিক দিগভ্রান্ত মানুষের ছুটোছুটি। আর কিছুক্ষণ পরপর আহতদের দলে যুক্ত হওয়া নতুন নতুন নাম। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, পিজি হাসপাতাল, মিটফোর্ড, পঙ্গু হাসপাতাল, হলি ফ্যামিলি, হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, শমরিতা হাসপাতালসহ প্রায় সব হাসপাতাল ভরে যায় গ্রেনেড হামলার আহত রোগীতে। গুরুতর আহতদের ভিড়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। স্থান সংকুলান না হওয়ায় আহতদের বিভিন্ন ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়। ওয়ার্ডের বেডগুলো ভরে গেলে মেঝেতে শুইয়ে রাখা হয় সংকটাপন্ন অনেককে। হাসপাতালের করিডরগুলোতেও পা ফেলার জায়গা ছিল না। সেখানে শুইয়ে রাখা হয় গুরুতর আহত অনেককে। রক্তাক্ত, হাত-পা উড়ে যাওয়া কিংবা স্প্লিন্টারের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়া হতভাগ্যদের রক্তে রঞ্জিত হয়ে ওঠে হাসপাতালের সামনের রাস্তা, সিঁড়ি, করিডর এবং বিভিন্ন ওয়ার্ড।

ঢাকা হয়ে ওঠে আতঙ্কের নগরী

সেদিন আওয়ামীলীগের জনসভায় বোমা বিস্ফোরণের পর থেকেই পুরো ঢাকা হয়ে ওঠে এক আতঙ্কের নগরী। ঘটনার পর দেখা যাচ্ছিল, বঙ্গবন্ধু এভিনিউর ওপরটা ঢেকে ছিল কালো ধোঁয়ার আকাশে। রাস্তায় ভাঙা কাচের গুঁড়োর সাক্ষী রেখে  ছুটে পালাচ্ছিল চলন্ত গাড়িগুলো। দুই ট্রাক পুলিশ ছিল হাইকোর্টের সামনের রাস্তায়। বুটের শব্দে ১০ দিক সচকিত করে তারা যাচ্ছেন অকুস্থলে। দুই পাশের রাস্তায় হাজার খানেক নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-শিশু দাঁড়িয়ে ছিল বিহ্বল হয়ে। সচিবালয়ে কাজ শেষে বাসায় ফেরার অপেক্ষায় ছিলেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কিন্তু কেউই রাস্তায় বের হওয়ার সাহস করছিলেন না।

নেতাকর্মীদের দুরবস্থা শুনে কেঁদে ফেলেন শেখ হাসিনা

গ্রেনেড হামলার পরপরই বিবিসি থেকে ফোন করা হয় আওয়ামী লীগ সভাপতিকে। সেদিন তিনি নিজের কথা ভুলে প্রথমেই বলেছিলেন, ‘আমার কর্মীরা জীবন দিয়ে আমাকে বাঁচিয়েছেন। গ্রেনেড যখন বিস্ফোরিত হচ্ছিল, তখন নেতাকর্মীরা আমাকে ঘিরে রেখেছিলেন। তাদের অনেকেই আহত হয়েছেন। এখনও আমার কাপড়ে তাদের রক্ত লেগে আছে।’ বলতে বলতে কেঁদে ফেলেছিলেন তিনি। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেছিলেন, ‘সরকারের মদদে সারা দেশেই বোমা হামলার ঘটনা ঘটছে। আমাদের এই মিছিলটাও ছিল বোমা হামলা ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। এ জন্যই তারা জবাব দিলো গ্রেনেড মেরে। আমার বক্তব্য শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে মুহূর্তে আমি সিঁড়ি দিয়ে নেমে গাড়িতে উঠবো ঠিক তখনই ওই জায়গাটাই হামলাকারীরা টার্গেট করেছিল। পর পর ৮-১০টা গ্রেনেড ফাটে। এখনও ওখানে দু-তিনটা অবিস্ফোরিত গ্রেনেড পড়ে আছে। আমাদের মহিলাকর্মীসহ অনেকে নিহত হয়েছেন। এতগুলো মানুষ মারা গেছেন। মানুষের জীবনের কি কোনও মূল্য নেই?’

এ প্রসঙ্গে (২০১৪ সালে) সেদিনের সুধা সদনের ভেতরের পরিবেশ বর্ণনা করে আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা লতিফ সিদ্দিকী বলেন, ‘নেত্রী (শেখ হাসিনা) কোনোরকমে সুধা সদনে ঢুকেই সবার খবর নিতে থাকেন। নিজের কথা ভুলে নেতাকর্মীরা কেমন আছেন, কেউ মারা গেছেন কিনা, আহতদের কোথায় কোথায় ভর্তি করা যায়, এ নিয়ে তৎপর হয়ে ওঠেন তিনি। তার নির্দেশনায় যতদূর সম্ভব সবার চিকিৎসা নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হয়। চারদিক থেকে ফোন আসছিল, তিনি ফোন ধরছিলেন আবার একইসঙ্গে প্রয়োজনীয় ফোন করছিলেনও।’

সূত্র : বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও স্মরণীকায় প্রকাশিত খবর, মামলার নথিপত্র এবং সাক্ষাৎকার।

— কলামিস্ট ও গণমাধ্যমকর্মী

About Syed Enamul Huq

Leave a Reply