Tuesday , 16 April 2024
E- mail: news@dainiksakalbela.com/ sakalbela1997@gmail.com
ব্রেকিং নিউজ
দ্বিতীয় দিনের মতো পণ্যবাহী নৌযান ধর্মঘট অব্যাহত
--সংগৃহীত ছবি

দ্বিতীয় দিনের মতো পণ্যবাহী নৌযান ধর্মঘট অব্যাহত

অনলাইন ডেস্ক:

খোরাকি ভাতাসহ ১১ দফা দাবিতে সারা দেশে দ্বিতীয় দিনের মতো পণ্যবাহী নৌযান ধর্মঘট অব্যাহত রয়েছে। এতে সারা দেশে নৌপথে পণ্য পরিবহন বন্ধ আছে। চট্টগ্রামে ২১ লাখ টন পণ্য নিয়ে অলস বসে আছে মাদার ও লাইটার জাহাজ।

মোংলা বন্দরেও কার্যত অচলাবস্থা বিরাজ করছে। দুই বন্দর ব্যবহারী ব্যবসায়ীরা চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন। দেশের শিল্প-কারখানার পণ্য সরবরাহ ও রফতানি বিঘ্নিত হচ্ছে। ধর্মঘটের সমর্থনে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল করেছে শ্রমিকরা। সোমবার মধ্যরাত থেকে নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের ডাকে এ ধর্মঘট শুরু হয়।

এদিকে পণ্যবাহী নৌযান ধর্মঘট নিয়ে মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে সমঝোতার পথ খুলতে শুরু করেছে। সরকার-মালিক-শ্রমিক- সব পক্ষই সমাধানের পথ খুঁজছে। দাবি আদায়ে আগের তুলনায় অনেকটা নমনীয় শ্রমিকরা। অন্যদিকে বেশির ভাগ নৌযান মালিকরা খোরাকি ভাতা দেয়ার চিন্তাভাবনা করছেন। তবে কী পরিমাণ খোরাকি ভাতা দেবেন তা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন তারা।

তিনটি গ্রুপ অব কোম্পানি নিজেদের জাহাজের শ্রমিকদের মাসে দুই হাজার টাকা খোরাকি ভাতা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এতে এক রকম চাপে পড়েছেন অন্য জাহাজ মালিকরা। পক্ষান্তরে ১১ দফা দাবিতে ধর্মঘট ডাকলেও এই মুহূর্তে খোরাকি ভাতার ঘোষণা পেলেই কর্মবিরতি স্থগিত করতে চান বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতা।

ধর্মঘট নিরসনে স্থানীয় মালিক ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করতে আজ বৃহস্পতিবার বৈঠকে বসছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক)। এছাড়া কার্গো মালিকদের একটি অংশ আজ ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করতে যাচ্ছেন।

চবক সূত্রে জানা গেছে, বন্দর সচল রাখতে আজকের বৈঠকে মালিক ও শ্রমিকদের নেতাদের ছাড় দেয়ার আহ্বান জানানো হবে। বুধবার মোংলা বন্দরে শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বন্দরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ধর্মঘট প্রত্যাহারে স্থানীয় শ্রমিক নেতাদের সহযোগিতা চেয়েছেন তারা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মাদ শাহজাহান বলেন, স্থানীয় শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। তাদের বন্দর সচল রাখতে ধর্মঘট প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়েছি। তারা আমাদের জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় নেতাদের সিদ্ধান্তের ওপর ধর্মঘট প্রত্যাহারের বিষয়টি নির্ভর করছে।

অপরদিকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এসএম আবুল কালাম আজাদ যুগান্তরকে বলেন, আমরা মালিক-শ্রমিক নেতাদের ডেকেছি। তাদের আলোচনার টেবিলে সমস্যা সমাধানের পথ খোঁজার আহ্বান জানানো হবে। তাদের বলা হবে, দেশের অর্থনীতির চাকা বন্ধ করার অধিকার কারও নেই। বন্দর ও ব্যবসা সচল রাখতে দু’পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে।

এছাড়া কেন্দ্রীয়ভাবেও মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক। তিনি বলেন, বেশির ভাগ মালিক ও শ্রমিক নেতারা পণ্য পরিবহন বন্ধ থাক তা চায় না। তবে সমাধান নেতাদের ওপর নির্ভর করছে। সব পক্ষ নমনীয় হলেই অচলাবস্থার নিরসন হবে।

মালিকরা এগিয়ে এলেই সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন ধর্মঘটী সংগঠন বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মো. শাহ আলম। তিনি বলেন, সমস্যা সমাধানে সব দিক থেকে চেষ্টা চলছে। শ্রমিকদের খোরাকি ভাতা দেয়ার ঘোষণা দিলে বাকি বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার টেবিলে সমাধান করা যাবে। এজন্য মালিকদের মহানুভবতা ও সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া দরকার। তবে দাবি আদায় না হলে কর্মবিরতি কর্মসূচি চলবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল (যাপ) সংস্থার প্রেসিডেন্ট মাহবুবউদ্দীন আহমদ বীরবিক্রম বলেন, শ্রমিক নেতারা ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিক। আমরা তাদের দাবি বিবেচনার জন্য আলোচনার টেবিলে বসব। তিনি আরও বলেন, তিনটি শ্রমিক ফেডারেশন রয়েছে। তাদের নিজেদের মধ্যেই মিল নেই। আমরা বারবার বলে আসছি, সিবিএ হয়ে আসুক।

২১ লাখ টন পণ্য নিয়ে অলস জাহাজ : চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে নদীপথে পণ্য পরিবহনে ভয়াবহ অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বন্দরের বহির্নোঙরে ৪০টি বিদেশি জাহাজ বুধবার পর্যন্ত প্রায় ৯ লাখ টন পণ্য নিয়ে অলস বসে ছিল। এসব জাহাজ থেকে কোনো ধরনের পণ্য খালাস হচ্ছে না। এ ছাড়া এর আগে মাদার ভেসেল (বড় জাহাজ) থেকে স্থানান্তর করা আরও প্রায় ১২ লাখ টন পণ্য নিয়ে নদীতে ও বিভিন্ন ঘাটে বসে আছে পৌনে ৯০০ লাইটার জাহাজ।

এসব পণ্য নদীপথে কর্ণফুলীর ১৬ ঘাটসহ সারা দেশের বিভিন্ন ঘাটে খালাস হওয়ার কথা ছিল। এ ছাড়া বহির্নোঙরে অলস বসে থাকা প্রতিটি বিদেশি জাহাজের বিপরীতে প্রতিদিন ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার ডলার পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ গুনতে হচ্ছে। যার মাশুল দিতে হবে সাধারণ ভোক্তাদের।

চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা বলেছেন, এমনিতেই করোনার ধাক্কা সামাল দিতে পারেননি ব্যবসায়ীরা। তার ওপর নতুন করে শ্রমিক ধর্মঘটে নদীপথে পণ্য পরিবহনে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে এর খেসারত দিতে হবে আমদানিকারক, ব্যবসায়ী, ভোক্তাসহ সব শ্রেণির মানুষকে। বিশেষ করে ভোক্তাদের ওপরই এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে।

ধর্মঘটের কারণে জরিমানা গোনাসহ যে আর্থিক ক্ষতি হবে তা পণ্যের সঙ্গে যোগ হয়ে ভোক্তাদের কাঁধেই উঠবে। তাছাড়া কাঁচামাল সরবরাহ বন্ধ থাকায় এরই মধ্যে বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সার্বিক বিষয় উল্লেখ করে এরই মধ্যে চট্টগ্রাম চেম্বারের পক্ষ থেকে সভাপতি মাহবুবুল আলম শ্রমমন্ত্রীকে চিঠি দেন।

চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানিয়েছে, বুধবার বন্দরের বহির্নোঙরে ৫৪টি জাহাজ অবস্থান করছিল। এর মধ্যে ৪০টি জাহাজ থেকে শ্রমিক ধর্মঘটের কারণে কোনো ধরনের পণ্য খালাস হচ্ছে না। উল্লেখযোগ্য পণ্যের মধ্যে রয়েছে ১০টি জাহাজে ১ লাখ ৪৮ হাজার ২১১ মেট্রিক টন ক্লিঙ্কার, ৮টি জাহাজে ২ লাখ ৫৫ হাজার ৮৭৪ মেট্রিক টন গম, ১টি জাহাজে ২৯ হাজার মেট্রিক টন স্ন্যাগ, তিনটি জাহাজে ১ লাখ ৪৬৫ মেট্রিক টন লাইম স্টোন, ১টি জাহাজে ৪৩ হাজার ১৯০ মেট্রিক টন চিনি, ১টি জাহাজে ১ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন পাথর রয়েছে।

এছাড়া আরও ১১টি ভেসেল বিভিন্ন পণ্য নিয়ে জেটিতে ভেড়ার জন্য পণ্য নিয়ে বন্দরের নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছে। বার্থিংয়ের জন্য অপেক্ষা করছে তিনটি বাল্ক কার্গো ভেসেল বা খোলা পণ্যবাহী জাহাজ। চট্টগ্রাম বন্দর সচিব ওমর ফারুক এসব তথ্য যুগান্তরকে নিশ্চিত করেন। সূত্র জানায়, কেবল ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের (ডব্লিউটিসি) নিয়ন্ত্রণাধীন পৌনে ৯০০ লাইটার জাহাজ ১১ লাখ ৯০ হাজার ৭৩৮ মেট্রিক নটন পণ্য বোঝাই করে বসে আছে।

বন্দরের বহির্নোঙরে আগত মাদার ভেসেল (বড় জাহাজ) থেকে এসব পণ্য স্থানান্তর করে লাইটার জাহাজে বোঝাই করা হয়েছে। কর্ণফুলীর ১৬ ঘাটসহ সারা দেশের বিভিন্ন ঘাটে এসব পণ্য খালাস করার কথা ছিল। এছাড়া বহুজাতিক ও ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানির অনেক লাইটার জাহাজও পণ্য বোঝাই করে বসে আছে। শ্রমিক ধর্মঘটের কারণে গন্তব্যে যেতে পারছে না।

নদীপথের লাইটার জাহাজ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের (ডব্লিউটিসি) যুগ্ম সচিব আতাউল করিম রঞ্জু বুধবার বিকালে বলেন, ডব্লিউটিসি’র অধীনে ১ হাজার ২৫০টি লাইটার জাহাজ (ছোট আকারের জাহাজ) রয়েছে। এর মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ৮৭৪ জাহাজ বিভিন্ন জায়গায় পণ্য বোঝাই অবস্থায় ছিল। এসব জাহাজে ১১ লাখ ৯০ হাজার ৭৩৮ মেট্রিক টন পণ্য রয়েছে।

এর বাইরে বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানির নিজস্ব জাহাজও আছে। প্রতিদিন ডব্লিউটিসির জাহাজ আউটার (বহির্নোঙর) থেকে ৪০ হাজার টন পণ্য খালাস করে। অন্যান্য জাহাজ মিলে প্রতিদিন ১ লাখ টন পণ্য খালাস করে। কিন্তু সোমবার থেকে শ্রমিক ধর্মঘটের কারণে এক টন পণ্যও খালাস হয়নি। সবগুলো জাহাজ বিভিন্ন ঘাটে অলস বসে আছে। তিনি আরও জানান, বন্দরের বহির্নোঙরে বিদেশি জাহাজ থেকে পণ্য খালাসের জন্য ১৯টা জাহাজ বুকিং ছিল। ধর্মঘটের কারণে সেসব জাহাজ যেতে বহির্নোঙরে যেতে পারেনি।

মোংলা বন্দর : মোংলা (বাগেরহাট) প্রতিনিধি জানান, নৌযান শ্রমিকদের টানা দু’দিনের লাগাতার কর্মবিরতিতে মোংলা বন্দর কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। পশুর চ্যানেলে অবস্থানরত জাহাজগুলো থেকে কোনো পণ্য বোঝাই খালাস কাজ হচ্ছে না। তবে বন্দর জেটি ও গ্যাস ফ্যাক্টরিতে সামান্য কাজ হচ্ছে। বন্দরে আজ সকালে ১২টি জাহাজ অবস্থান করেছিল। তবে এর মধ্যে দুপুরের পর ৫টি জাহাজ বন্দর ত্যাগ ও ১টি জাহাজের বন্দরে আগমনের কথা রয়েছে।

মোংলা বন্দরের পশুর চ্যানেল ও মোংলা খাঁড়িতে এ মুহূর্তে প্রায় ৩ থেকে ৪শ’ লাইটারেজ জাহাজ অবস্থান করে কর্মবিরতি পালন করছে। কর্মবিরতির শুরু থেকেই জাহাজের পাশ থেকে সব লাইটারেজ জাহাজ সরিয়ে এনে নদীতে নোঙর করে রাখা হয়েছে। এসব লাইটারেজ জাহাজের কর্মচারীরা এখন অলস সময় অতিবাহিত করছে। বাংলাদেশ-ভারত নৌ প্রটোকলভুক্ত আন্তর্জাতিক রুটসহ দেশের সব রুটে নৌচলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে করে অনেক ফ্যাক্টরিতে কাঁচামালের সংকটের আশঙ্কা রয়েছে।

শিপিং এজেন্ট ও মোংলা বন্দর ব্যবহারকারী এইচএম দুলাল জানান, নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে পণ্যবাহী বিদেশি জাহাজ এ বন্দরে আটকা পড়ছে। এতে প্রতিটি জাহাজের অনুকূলে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় প্রায় ২০ হাজার মার্কিন গচ্ছা দিতে হচ্ছে চাটার মালিককে। এছাড়া নৌপথে পণ্য পরিবহন বন্ধ থাকায় আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন আমদানিকারকরা।

এদিকে বরিশাল, মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ও সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলায় ধর্মঘটের সমর্থনে বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছে নৌযান শ্রমিকরা।

মোংলা বন্দরেও কার্যত অচলাবস্থা বিরাজ করছে। দুই বন্দর ব্যবহারী ব্যবসায়ীরা চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন। দেশের শিল্প-কারখানার পণ্য সরবরাহ ও রফতানি বিঘ্নিত হচ্ছে। ধর্মঘটের সমর্থনে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল করেছে শ্রমিকরা। সোমবার মধ্যরাত থেকে নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের ডাকে এ ধর্মঘট শুরু হয়।

এদিকে পণ্যবাহী নৌযান ধর্মঘট নিয়ে মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে সমঝোতার পথ খুলতে শুরু করেছে। সরকার-মালিক-শ্রমিক- সব পক্ষই সমাধানের পথ খুঁজছে। দাবি আদায়ে আগের তুলনায় অনেকটা নমনীয় শ্রমিকরা। অন্যদিকে বেশির ভাগ নৌযান মালিকরা খোরাকি ভাতা দেয়ার চিন্তাভাবনা করছেন। তবে কী পরিমাণ খোরাকি ভাতা দেবেন তা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন তারা।

তিনটি গ্রুপ অব কোম্পানি নিজেদের জাহাজের শ্রমিকদের মাসে দুই হাজার টাকা খোরাকি ভাতা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এতে এক রকম চাপে পড়েছেন অন্য জাহাজ মালিকরা। পক্ষান্তরে ১১ দফা দাবিতে ধর্মঘট ডাকলেও এই মুহূর্তে খোরাকি ভাতার ঘোষণা পেলেই কর্মবিরতি স্থগিত করতে চান বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতা।

ধর্মঘট নিরসনে স্থানীয় মালিক ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করতে আজ বৃহস্পতিবার বৈঠকে বসছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক)। এছাড়া কার্গো মালিকদের একটি অংশ আজ ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করতে যাচ্ছেন।

চবক সূত্রে জানা গেছে, বন্দর সচল রাখতে আজকের বৈঠকে মালিক ও শ্রমিকদের নেতাদের ছাড় দেয়ার আহ্বান জানানো হবে। বুধবার মোংলা বন্দরে শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বন্দরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ধর্মঘট প্রত্যাহারে স্থানীয় শ্রমিক নেতাদের সহযোগিতা চেয়েছেন তারা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মাদ শাহজাহান যুগান্তরকে বলেন, স্থানীয় শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। তাদের বন্দর সচল রাখতে ধর্মঘট প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়েছি। তারা আমাদের জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় নেতাদের সিদ্ধান্তের ওপর ধর্মঘট প্রত্যাহারের বিষয়টি নির্ভর করছে।

অপরদিকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এসএম আবুল কালাম আজাদ যুগান্তরকে বলেন, আমরা মালিক-শ্রমিক নেতাদের ডেকেছি। তাদের আলোচনার টেবিলে সমস্যা সমাধানের পথ খোঁজার আহ্বান জানানো হবে। তাদের বলা হবে, দেশের অর্থনীতির চাকা বন্ধ করার অধিকার কারও নেই। বন্দর ও ব্যবসা সচল রাখতে দু’পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে।

এছাড়া কেন্দ্রীয়ভাবেও মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক। যুগান্তরকে তিনি বলেন, বেশির ভাগ মালিক ও শ্রমিক নেতারা পণ্য পরিবহন বন্ধ থাক তা চায় না। তবে সমাধান নেতাদের ওপর নির্ভর করছে। সব পক্ষ নমনীয় হলেই অচলাবস্থার নিরসন হবে।

মালিকরা এগিয়ে এলেই সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন ধর্মঘটী সংগঠন বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মো. শাহ আলম। তিনি যুগান্তরকে বলেন, সমস্যা সমাধানে সব দিক থেকে চেষ্টা চলছে। শ্রমিকদের খোরাকি ভাতা দেয়ার ঘোষণা দিলে বাকি বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার টেবিলে সমাধান করা যাবে। এজন্য মালিকদের মহানুভবতা ও সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া দরকার। তবে দাবি আদায় না হলে কর্মবিরতি কর্মসূচি চলবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল (যাপ) সংস্থার প্রেসিডেন্ট মাহবুবউদ্দীন আহমদ বীরবিক্রম বলেন, শ্রমিক নেতারা ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিক। আমরা তাদের দাবি বিবেচনার জন্য আলোচনার টেবিলে বসব। তিনি আরও বলেন, তিনটি শ্রমিক ফেডারেশন রয়েছে। তাদের নিজেদের মধ্যেই মিল নেই। আমরা বারবার বলে আসছি, সিবিএ হয়ে আসুক।

২১ লাখ টন পণ্য নিয়ে অলস জাহাজ : চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে নদীপথে পণ্য পরিবহনে ভয়াবহ অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বন্দরের বহির্নোঙরে ৪০টি বিদেশি জাহাজ বুধবার পর্যন্ত প্রায় ৯ লাখ টন পণ্য নিয়ে অলস বসে ছিল। এসব জাহাজ থেকে কোনো ধরনের পণ্য খালাস হচ্ছে না। এ ছাড়া এর আগে মাদার ভেসেল (বড় জাহাজ) থেকে স্থানান্তর করা আরও প্রায় ১২ লাখ টন পণ্য নিয়ে নদীতে ও বিভিন্ন ঘাটে বসে আছে পৌনে ৯০০ লাইটার জাহাজ।

এসব পণ্য নদীপথে কর্ণফুলীর ১৬ ঘাটসহ সারা দেশের বিভিন্ন ঘাটে খালাস হওয়ার কথা ছিল। এ ছাড়া বহির্নোঙরে অলস বসে থাকা প্রতিটি বিদেশি জাহাজের বিপরীতে প্রতিদিন ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার ডলার পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ গুনতে হচ্ছে। যার মাশুল দিতে হবে সাধারণ ভোক্তাদের।

চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা বলেছেন, এমনিতেই করোনার ধাক্কা সামাল দিতে পারেননি ব্যবসায়ীরা। তার ওপর নতুন করে শ্রমিক ধর্মঘটে নদীপথে পণ্য পরিবহনে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে এর খেসারত দিতে হবে আমদানিকারক, ব্যবসায়ী, ভোক্তাসহ সব শ্রেণির মানুষকে। বিশেষ করে ভোক্তাদের ওপরই এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে।

ধর্মঘটের কারণে জরিমানা গোনাসহ যে আর্থিক ক্ষতি হবে তা পণ্যের সঙ্গে যোগ হয়ে ভোক্তাদের কাঁধেই উঠবে। তাছাড়া কাঁচামাল সরবরাহ বন্ধ থাকায় এরই মধ্যে বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সার্বিক বিষয় উল্লেখ করে এরই মধ্যে চট্টগ্রাম চেম্বারের পক্ষ থেকে সভাপতি মাহবুবুল আলম শ্রমমন্ত্রীকে চিঠি দেন।

চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানিয়েছে, বুধবার বন্দরের বহির্নোঙরে ৫৪টি জাহাজ অবস্থান করছিল। এর মধ্যে ৪০টি জাহাজ থেকে শ্রমিক ধর্মঘটের কারণে কোনো ধরনের পণ্য খালাস হচ্ছে না। উল্লেখযোগ্য পণ্যের মধ্যে রয়েছে ১০টি জাহাজে ১ লাখ ৪৮ হাজার ২১১ মেট্রিক টন ক্লিঙ্কার, ৮টি জাহাজে ২ লাখ ৫৫ হাজার ৮৭৪ মেট্রিক টন গম, ১টি জাহাজে ২৯ হাজার মেট্রিক টন স্ন্যাগ, তিনটি জাহাজে ১ লাখ ৪৬৫ মেট্রিক টন লাইম স্টোন, ১টি জাহাজে ৪৩ হাজার ১৯০ মেট্রিক টন চিনি, ১টি জাহাজে ১ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন পাথর রয়েছে।

এছাড়া আরও ১১টি ভেসেল বিভিন্ন পণ্য নিয়ে জেটিতে ভেড়ার জন্য পণ্য নিয়ে বন্দরের নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছে। বার্থিংয়ের জন্য অপেক্ষা করছে তিনটি বাল্ক কার্গো ভেসেল বা খোলা পণ্যবাহী জাহাজ। চট্টগ্রাম বন্দর সচিব ওমর ফারুক এসব তথ্য যুগান্তরকে নিশ্চিত করেন। সূত্র জানায়, কেবল ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের (ডব্লিউটিসি) নিয়ন্ত্রণাধীন পৌনে ৯০০ লাইটার জাহাজ ১১ লাখ ৯০ হাজার ৭৩৮ মেট্রিক নটন পণ্য বোঝাই করে বসে আছে।

বন্দরের বহির্নোঙরে আগত মাদার ভেসেল (বড় জাহাজ) থেকে এসব পণ্য স্থানান্তর করে লাইটার জাহাজে বোঝাই করা হয়েছে। কর্ণফুলীর ১৬ ঘাটসহ সারা দেশের বিভিন্ন ঘাটে এসব পণ্য খালাস করার কথা ছিল। এছাড়া বহুজাতিক ও ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানির অনেক লাইটার জাহাজও পণ্য বোঝাই করে বসে আছে। শ্রমিক ধর্মঘটের কারণে গন্তব্যে যেতে পারছে না।

নদীপথের লাইটার জাহাজ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের (ডব্লিউটিসি) যুগ্ম সচিব আতাউল করিম রঞ্জু বুধবার বিকালে যুগান্তরকে বলেন, ডব্লিউটিসি’র অধীনে ১ হাজার ২৫০টি লাইটার জাহাজ (ছোট আকারের জাহাজ) রয়েছে। এর মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ৮৭৪ জাহাজ বিভিন্ন জায়গায় পণ্য বোঝাই অবস্থায় ছিল। এসব জাহাজে ১১ লাখ ৯০ হাজার ৭৩৮ মেট্রিক টন পণ্য রয়েছে।

এর বাইরে বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানির নিজস্ব জাহাজও আছে। প্রতিদিন ডব্লিউটিসির জাহাজ আউটার (বহির্নোঙর) থেকে ৪০ হাজার টন পণ্য খালাস করে। অন্যান্য জাহাজ মিলে প্রতিদিন ১ লাখ টন পণ্য খালাস করে। কিন্তু সোমবার থেকে শ্রমিক ধর্মঘটের কারণে এক টন পণ্যও খালাস হয়নি। সবগুলো জাহাজ বিভিন্ন ঘাটে অলস বসে আছে। তিনি আরও জানান, বন্দরের বহির্নোঙরে বিদেশি জাহাজ থেকে পণ্য খালাসের জন্য ১৯টা জাহাজ বুকিং ছিল। ধর্মঘটের কারণে সেসব জাহাজ যেতে বহির্নোঙরে যেতে পারেনি।

মোংলা বন্দর : মোংলা (বাগেরহাট) প্রতিনিধি জানান, নৌযান শ্রমিকদের টানা দু’দিনের লাগাতার কর্মবিরতিতে মোংলা বন্দর কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। পশুর চ্যানেলে অবস্থানরত জাহাজগুলো থেকে কোনো পণ্য বোঝাই খালাস কাজ হচ্ছে না। তবে বন্দর জেটি ও গ্যাস ফ্যাক্টরিতে সামান্য কাজ হচ্ছে। বন্দরে আজ সকালে ১২টি জাহাজ অবস্থান করেছিল। তবে এর মধ্যে দুপুরের পর ৫টি জাহাজ বন্দর ত্যাগ ও ১টি জাহাজের বন্দরে আগমনের কথা রয়েছে।

মোংলা বন্দরের পশুর চ্যানেল ও মোংলা খাঁড়িতে এ মুহূর্তে প্রায় ৩ থেকে ৪শ’ লাইটারেজ জাহাজ অবস্থান করে কর্মবিরতি পালন করছে। কর্মবিরতির শুরু থেকেই জাহাজের পাশ থেকে সব লাইটারেজ জাহাজ সরিয়ে এনে নদীতে নোঙর করে রাখা হয়েছে। এসব লাইটারেজ জাহাজের কর্মচারীরা এখন অলস সময় অতিবাহিত করছে। বাংলাদেশ-ভারত নৌ প্রটোকলভুক্ত আন্তর্জাতিক রুটসহ দেশের সব রুটে নৌচলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে করে অনেক ফ্যাক্টরিতে কাঁচামালের সংকটের আশঙ্কা রয়েছে।

শিপিং এজেন্ট ও মোংলা বন্দর ব্যবহারকারী এইচএম দুলাল জানান, নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে পণ্যবাহী বিদেশি জাহাজ এ বন্দরে আটকা পড়ছে। এতে প্রতিটি জাহাজের অনুকূলে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় প্রায় ২০ হাজার মার্কিন গচ্ছা দিতে হচ্ছে চাটার মালিককে। এছাড়া নৌপথে পণ্য পরিবহন বন্ধ থাকায় আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন আমদানিকারকরা।

এদিকে বরিশাল, মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ও সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলায় ধর্মঘটের সমর্থনে বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছে নৌযান শ্রমিকরা।

About Syed Enamul Huq

Leave a Reply