Thursday , 25 April 2024
E- mail: news@dainiksakalbela.com/ sakalbela1997@gmail.com
ব্রেকিং নিউজ

১৯৭১’র এই দিনে স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করা হয়

অনলাইন ডেস্ক:

৩ মার্চ, ১৯৭১। এদিন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার কথা ছিল ঢাকায়। তা না হওয়ায় আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ঢাকায় দ্বিতীয় দিনের মতো এবং সমগ্র বাংলাদেশে প্রথম দিনের জন্য সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। হরতালের সময় শহরের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে যায়। ঢাকা হয়ে ওঠে প্রতিরোধের নগরী। হরতাল চলাকালে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত মিছিলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণ ও বিভিন্ন ঘটনায় সারা দেশে শতাধিক মানুষ নিহত হয়। ঢাকা ছাড়াও রংপুর এবং সিলেটে কারফিউ জারি করা হয়। ঢাকায় কারফিউর মেয়াদ শিথিল করে রাত ১০টা থেকে সকাল সাড়ে ৬টা পর্যন্ত বলবৎ করা হয়।

স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পূর্বঘোষিত আহ্বানে দুপুরে পল্টন  ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় বিশাল জনসমাবেশ। এই সমাবেশ থেকে স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করা হয়। এই ইশতেহারে ছিল স্বাধীনতাসংগ্রামের পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা। শুরুতে ছিল ঐতিহাসিক প্রস্তাব। এরপর ছিল স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের ঘোষণা ও কর্মসূচি। এরপর ছিল আন্দোলনের কর্মপন্থা, ধারা ও জয়ধ্বনি। গাণিতিক সংখ্যা ও বর্ণমালা দিয়ে ক্রমানুসারে এসব উল্লেখ করা হয়।

ইশতেহারের প্রস্তাবনায় ‘স্বাধীন বাংলার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বের প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখিয়া… দল-মত-নির্বিশেষে বাংলার প্রতিটি নর-নারীকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম চালাইয়া যাওয়ার আহ্বান’ জানানো হয়। শোষণহীন সমাজব্যবস্থা কায়েমের জন্য সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথাও ঘোষণা করা হয়।

এই প্রথম প্রকাশ্যে প্রস্তাব করা হয়, সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বপ্নের লালিত দেশের নাম হবে ‘বাংলাদেশ’। বাঙালির হৃদয়ে লালিত বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ হবে জাতীয় সংগীত। ২ মার্চ ছাত্র সমাবেশে ওড়ানো সবুজ জমিনের মাঝখানে লাল বৃত্ত, তার মধ্যে হলুদ মানচিত্রসংবলিত পতাকাকে জাতীয় পতাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ব্যবহার করতে বলা হয়।

কর্মপন্থায় স্বাধীনতার সংগ্রাম পরিচালনার জন্য প্রতিটি গ্রাম, মহল্লা, থানা, মহকুমা শহর ও জেলায় ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম কমিটি’ গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়। স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের ওপর আক্রমণরত যেকোনো শক্তিকে প্রতিরোধ, প্রতিহত, পাল্টা আক্রমণ ও খতম করার জন্য সব ধরনের সশস্ত্র প্রস্তুতি নিতে বলা হয়।

জয়ধ্বনি হিসেবে ‘স্বাধীন কর, স্বাধীন কর—বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘স্বাধীন বাংলার মহান নেতা—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর—বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ ইত্যাদি নির্ধারণ করা হয়। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ এই ইশতেহার পাঠ করেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই সমাবেশে উপস্থিত হওয়ার কথা ছিল না। তিনি আকস্মিকভাবে উপস্থিত হন এবং জনতার চাপে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন। বঙ্গবন্ধু অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। তিনি ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন। ওই সময়ে কোর্ট-কাচারি, সরকারি অফিস, কলকারখানা, রেল, স্টিমার, বিমানসহ সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার ও জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা পর্যন্ত খাজনা, ট্যাক্স বন্ধ করে দিতে জনগণের প্রতি আহবান জানান। পরিস্থিতির পরিবর্তন না হলে যা বলার তা ৭ই মার্চের জনসভায় বলবেন বলে জানান।

সেদিনের জনসভার স্মৃতিচারণা করে ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, ‘৩ মার্চ পল্টনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জনসভা ছিল। নেতা (বঙ্গবন্ধু) দুপুর প্রায় পৌনে ২টার সময় আমাকে ডেকে বললেন, তিনি পল্টনের জনসভায় বক্তৃতা করবেন। নেতা এসেছিলেন বাংলার জনতাকে সুশৃঙ্খল মরণজয়ী সংগ্রামের ডাক দিতে। মন্ত্রমুগ্ধ বাংলা তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল। দুষ্কৃতকারীদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সেই সভা ছিল অনির্ধারিত, কিন্তু জনতা ছিল অগণিত। সেদিনের ঘটনা বর্ণনাতীত। সভায় ১ নম্বর ইশতেহার দেওয়া হয়। জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা নির্ধারণ, বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন বাংলার সর্বাধিনায়ক ঘোষণা ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের আলোকে বর্তমান চারটি রাষ্ট্রীয় নীতির কথা সুস্পষ্টভাবে দফাওয়ারি ঘোষণা করা হয়।’

তখন পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল গুল হাসান। তাঁর লেখা ‘পাকিস্তান যখন ভাঙলো’ গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেন, ‘শেখ ২ ও ৩ মার্চকে প্রতিবাদ দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। পূর্ব পাকিস্তানে এ রকম দিবসের কমতি ছিল না। শেখের ঘোষণা ব্যাপক সমর্থন পেল। বিশেষ করে আমলাতন্ত্রের মধ্যে। ওরা এ পর্যন্ত প্রকাশ্যে সরকারকে অমান্য করা থেকে বিরত ছিল, যদিও ওদের সহানুভূতি কোথায় তা বুঝে ওঠা কঠিন ছিল না। এখন ওদের সরকারবিরোধী মনোভাব বৈধতা পেল। ২ মার্চ বেসামরিক কর্তৃপক্ষের অনুরোধে ঢাকায় আইন-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সহায়তার জন্য সেনাবাহিনী তলব করা হয়।’

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক ঘোষণায় আগামী ১০ মার্চ ঢাকায় নেতাদের সম্মেলন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। রাওয়ালপিন্ডির প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে ঘোষণা করা হয়, এই সম্মেলন অনুষ্ঠানের পর দুই সপ্তাহের মধ্যে জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আমন্ত্রণ তাত্ক্ষণিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানের পিপিপি নেতা ভুট্টোর উদ্দেশে বলেন, ‘গণতান্ত্রিক নিয়মে প্রণীত এক শাসনতন্ত্র যদি না চান তাহলে আপনাদের শাসনতন্ত্র আপনারা রচনা করুন। বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র আমরাই রচনা করব।’

চট্টগ্রাম বন্দরে আসা এমভি সোয়াদ থেকে সৈন্য ও গোলাবারুদ নামাতে জনতা পাকিস্তানি বাহিনী ও নাবিকদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে শতাধিক শ্রমিক নিহত হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বুলেটে আহতদের জীবন রক্ষায় জনগণের প্রতি ব্লাড ব্যাংকে রক্তদানের উদাত্ত আহ্বান জানান। তিনি জনসাধারণকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘বাংলার স্বাধিকারবিরোধী বিশেষ মহল নিজস্ব এজেন্টদের দিয়ে লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও উচ্ছৃঙ্খল ঘটনা ঘটাচ্ছে। স্বাধিকার আন্দোলন বিপথগামী করার এ অশুভ চক্রান্ত রুখতেই হবে।’

গণহত্যার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি সকাল ১১টায় বটতলায় প্রতিবাদসভা করে। এতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি আস্থা প্রকাশ করে স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করা হয়।

ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি নুরুল ইসলাম শহীদ মিনারে জনসভায় বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে।

সেদিন রাতে বাসায় ফিরে রুমী নতুন পতাকা, জাতীয় সংগীত আর স্বাধীনতার কথা জানান মা জাহানারা ইমামকে। জানান, পল্টনের জনসভায় ‘আমার সোনার বাংলা’ গান গাওয়ার পর নতুন পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে। মা শিহরিত হয়ে বললেন, ‘স্বাধীন বাংলার পতাকা? বলিস কি রে? কেমন দেখতে? রুমী কাগজ ও রঙিন পেন্সিল নিয়ে এঁকে এঁকে দেখাতে লাগলেন স্বাধীন বাংলার পতাকা। মা জানতে চান, ‘এই কয়েক দিন তো স্বাধিকারের কথাই শুনছি, নির্বাচিত জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথাই শুনছি, এর মধ্যে স্বাধীন বাংলার কথা কখন উঠল?’ রুমী জানান, চার খলিফা (আ স ম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখন ও নূরে আলম সিদ্দিকী) খুব চাপ দিচ্ছেন শেখকে (বঙ্গবন্ধু) স্বাধীনতা ঘোষণা করার জন্য। এভাবেই রুমীর মতো পুরো দেশের লাখো প্রাণের মাঝে ধীরে ধীরে ফুটে ওঠে স্বাধীনতার স্বপ্ন।

About Syed Enamul Huq

Leave a Reply