দেশের মাঠে বড় টুর্নামেন্ট মানেই যেন শিরোপা জয়ে তাদের যাত্রা-সমাপ্তি। ১৯৮৪ ইউরোতে সেটি দেখিয়েছে প্লাতিনির ফ্রান্স। ১৪ বছর পরে দেশম-জিদানের ফ্রান্স, ১৯৯৮ বিশ্বকাপে। তার ১৮ বছর পর আরেকটি শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চ ফ্রান্সের ঘরে, এবার ইউরো। আবারও ডাকছে শিরোপা। রোনালদোর পর্তুগালকে নির্বাক দর্শক বানিয়ে এবারও কি ট্রফি নিয়ে উৎসব করবে ফ্রান্স?
আয়োজক হিসেবে ফ্রান্স যে হ্যাটট্রিক শিরোপা জয়ের দুয়ারে দাঁড়িয়ে, সেটিকে ঘটনাচক্র বলতে পারেন। তবে সরল পাটিগণিতে মাঠের খেলার ব্যবচ্ছেদ করলেও তো ফ্রান্সকে এগিয়ে রাখতে হয়। ১৯৭৫ সালের পর ফ্রান্সকে কখনো হারাতে পারেনি পর্তুগাল। আর এই টুর্নামেন্টের নকআউট পর্বের তিন ম্যাচে ৯ গোল। ‘গ্রিজমান’ নামের সুপারসনিক জেটে চড়ে ফাইনাল। নীল জার্সির মানুষগুলোর মাথায় মুকুট দেখতে চাওয়া ফুটবল রোমান্টিকদের দোষ কোথায়!
আশা অবশ্য সব সময়ই ফলবতী হয় না। বাস্তবতার রুক্ষ জমিতে সুবর্ণ প্রত্যাশাও গড়াগড়ি খায়। সেদিকটা ভাবলে আজ সেন্ট ডেনিসে পর্তুগালও বিজয় ছিনিয়ে নিজেদের ফুটবল ইতিহাসকে লিখতে পারে নতুন করে। তাদের পুরোনো ইতিহাসের পাতায় পাতায় শুধু শূন্যতা। একটি পাতায় জড়াজড়ি করে আছে হতাশা ও দীর্ঘশ্বাস। সেই যে দেশের মাটিতে ২০০৪ ইউরোর ফাইনালে অখ্যাত গ্রিস তাদের কাঁদিয়ে গেল। আশ্চর্য যে, রোদনভরা ওই পাতাটাই পর্তুগিজ ইতিহাসের উজ্জ্বলতম অর্জন! কি ইউরো, কি বিশ্বকাপ—আর কোনো ফাইনালেই উঠতে পারেনি পর্তুগাল।
দুই ফাইনালিস্টের তুল্যমূল্য বিচারে পর্তুগালই অবশ্য বেশি নম্বর পাবে। রোনালদো-পেপের দল এগিয়ে আছে অভিজ্ঞতায়। ওঁদের ফুটবলটা যেন অঙ্কেরও। কোচ ফার্নান্দো সান্তোসের মস্তিষ্ক যে কৌশলের জন্ম দিচ্ছে, কাঁটায় কাঁটায় সেগুলোর সফল প্রয়োগ ঘটছে মাঠে। সে জন্যই গ্রুপে তৃতীয় পর্তুগাল ঠিকই ফাইনালে। অন্যদিকে ফ্রান্স গতির সঙ্গে মেশাচ্ছে আবেগ। ঝড়ের মতো আক্রমণ করতে গিয়ে পেছনে কী ঘটতে পারে, সেই হিসাবটা মাথায় থাকছে না। যেমনটা দেখা গেছে জার্মানিকে পরাভূত করা সেমিফাইনালের প্রথমার্ধে। গ্রিজমান ৬ গোল করে সোনার বুট হয়তো জিতেই গেছেন, সোনার বলটাও দৃষ্টিসীমায় দেখছেন ২৫ বছর বয়সী ফরাসি-বিস্ময়। তারপরও ফ্রান্স একটু পিছিয়ে থাকে। তাদের যে একজন রোনালদো নেই!
শিরোপা যদি হয় আকাঙ্ক্ষার উল্টো পিঠের প্রাপ্তি, সেটি মনে হয় রোনালদোর দলকে একেবারে আকুতি হয়ে চেপে বসেছে। পর্তুগালের নাম্বার টেন জোয়াও মারিওর কথাটা শুনুন, ‘আমি নিশ্চিত, পুরো দল এটিকে (ফাইনাল) ভাবছে জীবনের ম্যাচ। কারণ পর্তুগাল কখনো কোনো শিরোপা জেতেনি।’ ৯ গোল করে ইউরোর সর্বোচ্চ গোলদাতা ফ্রান্স কিংবদন্তি মিশেল প্লাতিনিকে ছুঁয়ে ফেলা রোনালদো এবারও জয়ের স্বপ্ন দেখছেন, যে স্বপ্নের রংটাকে দেখাচ্ছে সবচেয়ে গাঢ়, ‘১২ বছর হলো, আরেকটা ফাইনালে আমি। এটি আমার জন্য গৌরবের। আমি সব সময়ই পর্তুগালের হয়ে কিছু জিততে চেয়েছি এবং আশা করি এটাই সেই সময়।’ রোনালদোর মতো সহজাত গোলদাতা ফুটবলের পৃথিবী খুব বেশি দেখেনি। সুতরাং এই ৩১ বছর বয়সী ফরোয়ার্ডের স্বপ্নকে ফুলের সম্ভাষণ জানানোর মন না থাকলেও তাঁকে অসম্মান আপনি করতে পারেন না। ওই স্বপ্নটা পর্তুগিজ মেরুন-সবুজে হয়তো এখনো অনূদিত হয়নি, তবে ক্লাবের হয়ে সেটি স্বপ্নেরই সমান বড়। সেই স্বপ্ন রিয়াল মাদ্রিদে ফুটেছে ‘লা ডেসিমা’ কিংবা ‘উনডেসিমা’র রঙে। আজও কি সেই স্বপ্ন জলপাই রঙের ঢেউ তুলবে প্যারিসের সেন্ট ডেনিসে?
মাদ্রিদ প্রসঙ্গটা এসেছে রোনালদোর সূত্রে। তবে এই ফাইনালের নেপথ্য সংগীতেও তো কেমন ছড়িয়ে আছে মাদ্রিদের সুর কিংবা রং। এপাশে রোনালদো, ওপাশে গ্রিজমান। এ তো রিয়াল মাদ্রিদ বনাম অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ রূপ নিয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে মাদ্রিদ ডার্বির অনুরণনও। পর্তুগালের যদি থাকেন সিআর সেভেন বা রন, ফ্রান্সের আছে গ্রিজমান—গ্রিজু। ফ্রান্সের ফুটবল ইতিহাসে গ্রিজু এই টুর্নামেন্ট দিয়েই নিজেকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যে প্লাতিনি প্রজন্ম, জিদান বা জিজু প্রজন্মের পর এই দলটিকে বলা হচ্ছে ‘গ্রিজু প্রজন্ম’। গ্রিজুর পেছনে এক হয়ে দাঁড়িয়েছে লা ব্লুরা। আর এই ঐক্য গত নভেম্বরে প্যারিসের রক্তাক্ত স্মৃতি, বন্যা, ধ্বংস আর ২০১০ বিশ্বকাপে ফ্রান্সের যাবতীয় নেতিবাচক বিজ্ঞাপনকে মুছে নতুন আলোয় রাঙাবে বলে মনে করছেন হুগো লরিস, ফ্রান্স গোলকিপার ও অধিনায়ক। ‘ফরাসি জনতা সত্যিই এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ওসব মুছে দিতে চায়। মানুষকে এক করে দেওয়ার সেই শক্তি খেলাটার আছে। আমাদের এখনো একটা সিঁড়ি ভাঙতে হবে, সেটি কঠিনতম জানি, কিন্তু সেটি পেরিয়ে যাওয়ার যোগ্যতা আমাদের আছে’—লরিসের এই কথা শুনে মনে হচ্ছে না, শিরোপা জয়ের আকুতি ফ্রান্সেরও কম নয়!
তাহলে যা দাঁড়াচ্ছে, আজ রাতে প্যারিসে বাংলাদেশ সময় ১টায় শুরু ইউরোর ফাইনালটা শুধুই একটি খেলা হবে না। এর মধ্যে থাকবে দুটি দেশেরই জনতার বিজয়াকাঙ্ক্ষা। সেই আকাঙ্ক্ষায় ছবি আর কবিতার দেশ নীল রঙের ক্যানভাস হয়ে উঠবে, নাকি থোকা থোকা ফুটবে সবুজ–মেরুন পুষ্পগুচ্ছ? সূত্র: এএফপি, রয়টার্স।
