অনলাইন ডেস্ক:
করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত দেশের সিমেন্টশিল্পের জন্য যখন প্রয়োজন বড় ধরনের কর প্রণোদনা, তখন এই খাতটি আরো বৈষম্যের মুখে পড়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ শিল্পের অন্যতম কাঁচামাল ক্লিংকার আমদানিতে প্রায় ১৪ শতাংশ হারে টনপ্রতি ৫০০ টাকা শুল্ককর অব্যাহত রাখা হয়েছে।
শুধু তা-ই নয়, সিমেন্টের মানোন্নয়নে ব্যবহৃত প্রিপেয়ার্ড এডিটিভস ফর সিমেন্টস, মর্টারস অর কংক্রিটস (এইচএস কোড : ৩৮২৪.৪০.০০) আমদানিতে যেখানে ৫ শতাংশ শুল্ক ছিল, প্রস্তাবিত বাজেটে সেটি বাড়িয়ে করা হয়েছে ১০ শতাংশ। এটিকে চরম বৈষম্যমূলক বলে আগের ৫ শতাংশ শুল্কের দাবি জানিয়েছেন এ শিল্পের উদ্যোক্তারা।
এ ছাড়া ফ্লাই অ্যাশ আমদানিতে আরোপিত রেগুলেটরি ডিউটি ৫ শতাংশ শুল্ক বহাল রয়েছে। এই শুল্ক বাতিলের দাবি জানিয়ে উদ্যোক্তারা বলছেন, এটি অত্যাবশ্যকীয় কাঁচামাল হওয়ায় শুল্ক প্রত্যাহার করা উচিত। অন্যদিকে সিমেন্টশিল্পের জন্য অগ্রিম আয়কর ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ প্রস্তাব করা হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। এটিও প্রত্যাহারের দাবি ছিল এই শিল্প খাতসংশ্লিষ্টদের।
বৈষম্যমূলক করারোপের এ বিষয়টি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে আমাদের দেশীয় সিমেন্টশিল্পকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কর প্রণোদনা দেওয়া উচিত ছিল। কারণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে হলে নির্মাণ খাতকে উজ্জীবিত করতে হবে। পাশাপাশি কর্মসংস্থান ধরে রাখতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে প্রচুর উন্নয়নমূলক কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। এসব উন্নয়ন কার্যক্রমের অন্যতম প্রধান উপকরণ সিমেন্ট। তাই দেশীয় সিমেন্টশিল্পের অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহারসহ অন্যান্য শুল্ক কমানো উচিত।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সম্ভাবনাময় এই খাতটি যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের ‘রূপকল্প-২০২১’-এর উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল; পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ দেশের মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় সিমেন্টের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছিল, তখন ভয়াবহ করোনা মহামারি দেশের সিমেন্টশিল্পে সংকট সৃষ্টির পাশাপাশি এই শিল্পে ৪২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হুমকিতে ফেলে দিয়েছে। ঝুঁকিতে পড়েছেন এই শিল্পে জড়িত হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারী।
সিমেন্টশিল্পের উদ্যোক্তারা বলছেন, করোনাকালে নতুন বাজেটে প্রস্তাবিত করহার যেন সিমেন্টশিল্পের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। করোনা মহামারির কারণে দেশের সব ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বন্ধ। এ ধরনের বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে যখন নতুন বাজেটে আরো বেশি কর সুবিধার প্রয়োজন ছিল তখন উল্টো আমদানি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে।
ক্লিংকার আমদানিতে শুল্কারোপ অযৌক্তিক দাবি করে সিমেন্টশিল্পের উদ্যোক্তারা বলছেন, সিমেন্টের প্রধান কাঁচামাল ক্লিংকার আমদানিতে শুল্ক টনপ্রতি ৫০০ টাকা আরোপ কোনোভাবেই অন্য দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। প্রতি টন ক্লিংকার বর্তমানে ৪২ ডলার হিসাবে আমদানি করা হয়। সে হিসাবে এই ৫০০ টাকা আমদানি শুল্ক শতাংশের হিসাবে ১৪ শতাংশ, যা অযৌক্তিক। তাঁরা বলছেন, এটি ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা কিংবা টনপ্রতি ৩০০ টাকা নির্ধারণ করা উচিত।
অগ্রিম আয়কর নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, চলতি অর্থবছরের বাজেটে অগ্রিম আয়কর ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয় এবং তা অসমন্বয়যোগ্য বলে চূড়ান্ত দায় হিসাবে বাস্তবায়ন করা হয়। কিন্তু পৃথিবীর কোনো দেশে অগ্রিম আয়কর চূড়ান্ত দায় হিসাবে বিবেচনা করা হয় না। উদ্যোক্তারা চান অগ্রিম আয়কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হোক।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত সব সিমেন্ট কম্পানির সম্মিলিতভাবে ৭৫০ কোটি টাকারও বেশি অসমন্বিত অগ্রিম আয়কর সরকারি কোষাগারে জমা পড়ে আছে। যদি ১০ শতাংশ হারে সুদ বিবেচনায় নেওয়া হয়, তাহলে সিমেন্ট খাতটি শুধু সুদ হিসাবে প্রতিবছর ৭৫ কোটি টাকা হারাচ্ছে।
বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমএ) প্রেসিডেন্ট ও ক্রাউন সিমেন্ট গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান মো. আলমগীর কবির বলেন, আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪-এর ১৪৬ নম্বর সেকশন অনুযায়ী, করদাতার পরিশোধিত টাকা পরিশোধযোগ্য করের চেয়ে বেশি হলে তা ফেরত পাওয়ার যোগ্য। ফেরত দিতে দেরি হলে সরকার যতক্ষণ পর্যন্ত না তা ফেরত দেবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার ওপর ৭.৫ শতাংশ হারে সুদ প্রদান করবে। কিন্তু এ ফেরতযোগ্য টাকাগুলো বছরের পর বছর পড়ে থাকে। এই টাকাগুলো ছাড় করা গেলে সিমেন্ট কম্পানিগুলো কিছু নগদ অর্থের সরবরাহ পাবে এবং এই কঠিন পরিস্থিতিতে অর্থায়নের খরচ কিছুটা কমিয়ে আনতে পারবে।
করোনা মহামারিজনিত বিপর্যয় : সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সিমেন্ট খাতে করোনার প্রভাব ক্রমেই ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। সরকার ঘোষিত লকডাউন শুরু হওয়ার পর এপ্রিল মাস পর্যন্ত সিমেন্ট কারখানাগুলোয় ৯০ শতাংশ উৎপাদন বন্ধ ছিল, যা এখন ৬০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অথচ শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা চালিয়ে যেতে হচ্ছে। পরিচালন খরচও কমেনি। অথচ দেশের সিমেন্টশিল্প থেকে বছরে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব যায় সরকারের কোষাগারে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, দেশের উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং অবকাঠামো খাতে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগের ওপর ভিত্তি করে সিমেন্ট খাতে দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি হয়ে আসছিল। কিন্তু ওই বছর থেকেই এ প্রবৃদ্ধি নেমে আসে ৬.৩৮ শতাংশে। এর অন্যতম কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়া, অসমন্বয়যোগ্য অগ্রিম আয়কর, তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে সিমেন্টের নিম্নমুখী দামের প্রবণতা এবং নদীপথে ও সড়কপথে পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়া। ফলে প্রায় সব সিমেন্ট কম্পানিকে ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। এমন পরিস্থিতিতে সিমেন্ট খাত যখন ২০২০ সালের শুরুতে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল তখন আঘাত হানে করোনা মহামারি।
আলমগীর কবির আরো বলেন, ‘এখনো অনুমান করা যাচ্ছে না করোনা মহামারির এ পরিস্থিতি কত দিন চলবে। খুচরা বাজারমূল্য অনুযায়ী হিসাব করলে বাংলাদেশে করোনা শনাক্তের পর থেকে এ পর্যন্ত সিমেন্ট খাতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। এই ক্ষতি পূরণ করতে কত সময় লাগবে তা এখনো অনুমানের বাইরে। এ অবস্থায় সরকারের কর প্রণোদনা ছাড়া দেশের সম্ভাবনাময় সিমেন্টশিল্পকে টিকিয়ে রাখা যাবে না।’