Friday , 19 April 2024
E- mail: news@dainiksakalbela.com/ sakalbela1997@gmail.com
ব্রেকিং নিউজ
অপার্থিব মেসিকে দেখাও পরম সৌভাগ্য
--সংগৃহীত ছবি

অপার্থিব মেসিকে দেখাও পরম সৌভাগ্য

অনলাইন ডেস্ক:

অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের হওয়ার মুখে সামনে দিয়ে চলে গেল একটি কালো বিড়াল। এর পর থেকে মনে কু ডাকছিল। মেসির বিশ্বকাপ কি সম্পূর্ণ হবে! শঙ্কিত মনে ঘুরেফিরে আসছিল মারাকানা। আট বছর আগে ব্রাজিল বিশ্বকাপের ফাইনালে হারের পর লিওনেল মেসির অশ্রুসজল সেই ছবি কি ভোলা যায়! টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার নিতে মঞ্চে যাওয়ার সময়ও যেন পা চলছিল না তাঁর।

kalerkanthoপ্রথমার্ধে একতরফা খেলে আর্জেন্টিনা এগিয়ে ২-০ গোলে। দূর, কিসের অপয়া কালো বিড়াল! আরে, এ তো বোকা জুনিয়র্সের মাঠ। ম্যারাডোনার ক্লাবের গ্যালারির মতো লুসাইলেও আর্জেন্টাইন সমর্থকদের গগনবিদারী উল্লাস। ভিভিআইপি বক্সে ম্যারাডোনার থাকার উপায় নেই। তবে নির্ঘাত ওপার থেকে মুষ্টিবদ্ধ হাত ছুড়ে উল্লাস করছেন ডিয়েগো ম্যারাডোনাও। এখানে মারাকানার মরাকান্নার কোনো আশঙ্কাই নেই। কিন্তু টুইস্টে ভরপুর বিশ্বকাপের গল্প কি আর এক অর্ধে শেষ হয়!

পরের আধাঘণ্টাও সব ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু কিলিয়ান এমবাপ্পের কয়েক মিনিটের বিস্ফোরণে কল্পিত বোকা জুনিয়র্সের স্টেডিয়ামকে মনে হচ্ছিল ২০১৪ সালের মারাকানা! লুসাইলে যেন বজ্রপাত হয়েছে, হঠাৎ নীরবতা। কিছু কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছিল। তাতে বোঝা গেল ফাইনালে ফরাসি সমর্থকও ছিল! আরো ভয় হচ্ছিল মেসিকে দেখে। অপবাদ আছে, এসব মুহূর্তে মেসি গুটিয়ে যান এবং দল হারে। তবু সুসময়ের মতো দুঃসময়েও আর্জেন্টাইনরা ধরনা দেয় মেসির কাছে, যদি জাদুকরী কিছু করেন তিনি। অতিরিক্ত সময়ে তাঁর গোলেই আবার আর্জেন্টিনা ঘুরে দাঁড়ায়। সেটাও ভণ্ডুল করে দেন এমবাপ্পে। শুধু ম্যাচ কেন, গোলের হ্যাটট্রিকে ম্যাচের সব আলো তখন এই ফরাসির ওপর। রাজাকে ছেড়ে বিশ্বকাপ কি তবে ঝুঁকছে যুবরাজের দিকে? রাজাও রাজ্যের হতাশা মুখে ফুটিয়ে ঝুঁকে পড়েছেন। দুই গোলে এগিয়ে থেকেও নির্ধারিত সময়ে শিরোপা জিততে না পারার হতাশা অতিরিক্ত সময়ের গোলে ভুলিয়েই দিয়েছিলেন মেসি। কিন্তু সেই অগ্রগামিতাও ধরে রাখা যায়নি, বক্সের ভেতর মন্তিয়েলের হাতে বল লাগায় পেনাল্টি পায় ফ্রান্স, হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেন এমবাপ্পে। অতঃপর টাইব্রেকার আবার ফিরিয়ে আনে ব্রাজিল বিশ্বকাপের দুর্ভাগ্যের স্মৃতি। ফুটবল ঈশ্বর কি তবে এবারও খালি হাতে ফিরিয়ে দেবেন মেসিকে?

না, এবার ফুটবল ঈশ্বরের মনে অন্য কিছুই ছিল। হতে পারে, সারা বিশ্বের ফুটবল জনতার মতো তিনি মেসির নার্ভেরও চূড়ান্ত পরীক্ষা উপভোগ করতে চেয়েছেন! সাধারণত বিশ্বকাপের ফাইনাল হয় ম্যাড়মেড়ে, সেই ধারণা ভেঙে ফুটবলের বিশ্বরূপ দর্শনের সুযোগ করে দিয়েছেন তারা। রাজা ও যুবরাজের ফাইনাল যখন এমন উচ্চমার্গে পৌঁছে গেছে, তখন টাইব্রেকারের রোমাঞ্চ বাদ যাবে কেন। সেখানে গোলরক্ষক এমি মার্তিনেজ যথারীতি প্রাচীর হয়ে সব দুর্ভাগ্য উড়িয়ে দিয়ে কাতার বিশ্বকাপের গায়ে লাগিয়ে দিয়েছেন ‘লিওনেল মেসির বিশ্বকাপ’ এর সিলমোহর।

২০১৪ বিশ্বকাপের একটি ছবি অনেকেই আর্কাইভে রেখে দিয়েছেন নিশ্চয়, যে ছবিতে মেসির পেছন দিকটা দেখা যাচ্ছে…বিশ্বকাপ ট্রফি পেরিয়ে মঞ্চে উঠছেন তিনি, হৃদয়ভাঙার অব্যক্ত বেদনা নিয়ে। সেই তিনি চার বছর পর লুসাইলে টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার নেওয়ার পর বিশ্বকাপ ট্রফির সামনে দাঁড়ালেন, হাত বুলিয়ে চুমুও খেলেন। কয়েক সেকেন্ডের প্রতিটা ফ্রেম অপার্থিব মনে হচ্ছিল। মেসি আবেগের অপচয় করেন না বরং মাঝেমধ্যে অতি সংযত। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর নিজের করে পাওয়া কাপ ছোঁয়ার সময় মুখে স্মিত হাসি। অবশ্য এই টুকরো হাসি হাজার প্রাপ্তির সঙ্গে একমাত্র অপ্রাপ্তিও মুঠোয় নেওয়ার। এমন কিছু তো মেসি একা চাননি। তাঁর হাতে বিশ্বকাপ দেখতে চেয়েছিল বিশ্বের শতকোটি ফুটবল অনুরাগী।

বিশ্বকাপে মেসির চুমুর দৃশ্যটি হয়ে গেছে বিশ্বকাপ ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে অমূল্য। বিশ্বের সেরা ফুটবলারটি পাঁচবারের চেষ্টায় বিশ্বকাপ প্রেমকে পূর্ণতা দেওয়ার নতুন নজিরে মহিমান্বিত হয়েছে বিশ্বকাপও। ফুটবলের সেরা টুর্নামেন্টটিও ইতিহাসের সেরা ফুটবলারের ঋণ শোধ করেছে। তাই শিরোপা আলিঙ্গনের পর লিওনেলও বলেছেন, ‘আমি জানতাম, ঈশ্বর বিশ্বকাপ উপহার দিতে যাচ্ছেন আমাকে। ’

রবিবারের পর ফায়সালা হয়ে গেছে বহু পুরনো এক বিতর্কেরও। পেলে-ম্যারাডোনাসহ তাবৎ কিংবদন্তিকে পেছনে ফেলে লিওনেলই বসলেন ফুটবল ইতিহাসের শীর্ষে। আর আর্জেন্টিনার মানুষের হৃদয়ে একাকার হয়ে গেলেন মেসি-ম্যারাডোনা। তবে সেটা হলো ম্যারাডোনার মৃত্যুর দুই বছর পর।

আর্জেন্টিনায় ম্যারাডোনার অবস্থান অনেক উঁচুতে। নানা কারণে ’৮৬-র বিশ্বকাপজয়ী নায়ককে হৃদয়ে ধারণ করে আর্জেন্টাইনরা। ফুটবলে ম্যারাডোনাই যেন শেষ কথা। কিন্তু শেষ কথা বলে তো আদতে কিছু নেই। তৃতীয়বার বিশ্বকাপ জয়ের পর মেসিকে নিয়ে বিশ্বব্যাপী যা তোলপাড় হচ্ছে, অতটা ম্যারাডোনাকে নিয়েও হয়নি। ফাইনালের পর বুয়েনস এইরেস ছেয়ে গেছে মেসির জন্য নীল ভালোবাসায়। আর্জেন্টাইনদের কাছে ম্যারাডোনা ম্যারাডোনাই থাকবেন। তবে সেই রাজসিংহাসনে মেসিও বসার অধিকার পেয়ে গেছেন। এ নিয়ে আর কোনো বিতর্ক নেই। বিশ্বকাপজুড়েই আর্জেন্টিনা ম্যাচে ম্যারাডোনার সঙ্গে মেসির ছবি সংবলিত ব্যানার, টি-শার্ট দেখা গেছে। শুধু দেখা যায়নি সশরীরের ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনাকে। খুব শখ ছিল তাঁর, মেসির বিশ্বজয় দেখবেন। নিশ্চয় তিনি দেখেছেন, অভিবাদনও জানিয়ে থাকবেন মেসিকে।

আহা, রুদ্ধশ্বাস কাতার বিশ্বকাপের শেষ দৃশ্যটা যদি এমন হতো—মেসিকে বিশ্বকাপ জিততে দেখে ভিভিআইপি বক্স থেকে উল্লাসে বুক চাপড়াচ্ছেন ম্যারাডোনা! এক জীবনে সব তো আর মেলে না। ম্যারাডোনা পরপারে, মেসি তো আছেন। আর্জেন্টিনার ‘থ্রি স্টার’ জার্সি গায়ে আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলবেন আরো কিছুদিন।

ফুটবলব্রহ্মাণ্ডের এ পরম এক সৌভাগ্য যে, লিওনেল মেসি এখনই জাদু গুটিয়ে নিচ্ছেন না। সে কালো বিড়াল যতই হুটহাট সামনে এসে পড়ুক না কেন!

সূত্র: কালের কন্ঠ অনলাইন

About Syed Enamul Huq

Leave a Reply