Monday , 29 April 2024
E- mail: news@dainiksakalbela.com/ sakalbela1997@gmail.com
ব্রেকিং নিউজ
উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম কার্টুনিস্ট শৈলকুপার কাজী আবুল কাসেম
--প্রেরিত ছবি

উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম কার্টুনিস্ট শৈলকুপার কাজী আবুল কাসেম

ঝিনাইদহ  প্রতিনিধি:

উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম কার্টুনিস্ট ছিলেন কাজী আবুল কাসেম। গুণী এই কার্টুনিস্ট ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার উমেদপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। নতুন প্রজন্ম তো বটেই, হয়তো অনেকেই এই বিখ্যাত কার্টুনিস্টের নামই জানেন না। অথচ ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মহান সৈনিক কাজী আবুল কাসেম তার আঁকা ‘হরফ খেদাও’ কার্টুন চিত্রটির জন্য বিশ্বব্যাপী স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম কার্টুনিস্ট, প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী ও শিশুসাহিত্যিক কাজী আবুল কাসেম ১৯১৩ সালের ৭ মে ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলার উমেদপুর গ্রামে নানা বাড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন। পৈতৃক নিবাস রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলার পারকুলা গ্রামে। তার পিতা কাজী মকবুল আলী শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম আধুনিক মুসলিম গদ্যশিল্পী মীর মশাররফ হোসেনের বন্ধু। মাতা মেহেরউন্নিসা খাতুন উমেদপুরের সম্ভ্রান্ত আলেম বংশের গুণান্বিত মহিলা ছিলেন। কাজী আবুল কাসেম মাত্র চার বছর বয়সে পিতা এবং পাঁচ বছর বয়সে মাকে হারান। শৈশবেই চিত্রকলার প্রতি আকর্ষণ ছিল। তিনি নিভৃতে ছবি আঁকতে ভালবাসতেন। বড় ভাই কাজী আবুল হোসেন (১৯১১-১৯৭৪, কথাসাহিত্যিক) এ বিষয়ে তার একমাত্র উৎসাহদাতা ছিলেন। ১৯২৬ সালে তার চিত্রকর্মে মুগ্ধ হয়ে ফরিদপুর শহরের এক পাদ্রি তাকে নিয়ে কলকাতা যান গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে ভর্তি করানোর উদ্দেশ্যে। ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও বয়স কম হওয়ার কারণে দেশে ফিরে আসেন। ১৯২৮ সালে আসাম হয়ে পুনরায় কলকাতা যান। ১৯৩০ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন সম্পাদিত বিখ্যাত মাসিক সওগাত পত্রিকায় তার প্রথম কার্টুনচিত্র ছাপা হয়। এর মাধ্যমে শৈলকুপার কৃতি সন্তান কাজী আবুল কাসেম চিহ্নিত হন প্রথম বাঙালি মুসলিম কার্টুনিস্ট ও চিত্রশিল্পী হিসেবে। এরপর বহু দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকায় তার আঁকা একরঙা ও বহুরঙা চিত্র ও কার্টুন প্রকাশিত হতে থাকে। অসংখ্য বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ ঘটে তার নিপুণ হাতে পরম আন্তরিকতা ও বিশ্বস্ততায়। কাজী আবুল কাশেম দোপেঁয়াজা ছদ্মনামে ভাষা আন্দোলনবিষয়ক কার্টুন আঁকতেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন “হরফ খোদাও” কার্টুন এঁকে পাক সরকারের ভীত কাঁপিয়ে দেন। কলকাতার কমার্শিয়াল আর্ট স্টুডিওতে তিনি সামান্য বেতনে চাকরি শুরু করে অল্প সময়ে প্রতিষ্ঠানের প্রধান চিত্রকর্মী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯৪১ সালে বেঙ্গল গভর্নমেন্টের শিল্প বিভাগে চাকরি নেন। ১৯৫০ সালের গোড়ার দিকে শিল্প বিভাগের আওতায় ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার ফর ডিমোবিলাইজড পার্সোনেলের বালিগঞ্জ শাখায় শিক্ষকের পদে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৫০ সালের মধ্যভাগে তিনি কলকাতা থেকে এসে প্রথমে কিছু দিন খুলনা ছিলেন, পরে ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৬০ সালে এক বছর অস্থায়ীভাবে টেকস্ট বুক বোর্ডের আর্ট রিভুয়ার এবং ১৯৬১ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ফ্রাঙ্কলিন বুক প্রোগ্রামসের প্রধান শিল্প নির্দেশক ও শিশুসাহিত্যের বইয়ের রিভুয়ার হিসেবে চাকরি নেন। অবিভক্ত বাংলার একজন পথিকৃৎ চিত্রশিল্পী ও কার্টুনিস্ট ছাড়াও তিনি শিশুসাহিত্যিক, ছড়াকার, শৌখিন কণ্ঠশিল্পী, আধুনিক এক বিজ্ঞানমনা ব্যক্তিত্ব হিসেবেও সুপরিচিত ছিলেন। তিনি বাংলা একাডেমি পদক, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র স্বর্ণপদক, এস এম সুলতান স্বর্ণপদক, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি পুরস্কার ও নাসির উদ্দীন স্বর্ণপদকসহ বিভিন্ন সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। শিল্পী কাজী আবুল কাসেম তাঁর আত্মকথায় লিখছেন: ‘আমি লেখক নই। সামান্য চিত্রকর, তাও আবার কমার্শিয়াল ছবি, ভুখা-নাঙ্গা ঘুচানোর তাগিদে। কলকাতায় ছিলাম, অনেক বড় বড় লেখকের লেখা পড়েছি। মুগ্ধ হয়েছি, হেসেছি, কেঁদেছি। এখানে শরৎচন্দ্র নেই, তারাশঙ্কর নেই, কিন্তু বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। বার্ধক্যের দোরগোড়ায় আসতেই একে একে বেরিয়ে এলেন শওকত ওসমান, হুমায়ূন আহমেদ প্রমুখ সোনার চাঁদ লেখকেরা। এঁদের লেখা পড়ে আনন্দ আর শান্তি দুটোই ফিরে পেলাম আবার।’ কার্টুনিস্ট কাজী আবুল কাসেম যতই বলনু ‘আমি লেখক নই’, তিনি অবশ্যই লেখক। শিশুসাহিত্যে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৭৮ সালে। এ কথা চোখ বন্ধ করে বলা যায়, তাঁর স্মৃতিকথা ‘পূবের জানালা’ যারা পড়বেন, বিস্মিত হবেন। তার প্রতিভা বিকশিত হয় একজন সহজাত শিল্পী হিসেবে। পেশাদার হলেও তার প্রকৃত ও মৌলিক শিল্পীসত্তা কখনো পরাভূত হয়নি। ২০০৪ সালের ১৯ জুলাই এই মহান মানবতাবাদী শিল্পী ও সাহিত্যিক এবং আমাদের সাংস্কৃতিক রেনেসাঁর অন্যতম পুরুষ ঢাকার ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে ৯১ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।

About Syed Enamul Huq

Leave a Reply