Saturday , 27 April 2024
E- mail: news@dainiksakalbela.com/ sakalbela1997@gmail.com
ব্রেকিং নিউজ
মহান বিজয় দিবস আজ/ অন্য এক বাংলাদেশ
--সংগৃহীত ছবি

মহান বিজয় দিবস আজ/ অন্য এক বাংলাদেশ

অনলাইন ডেস্ক:

‘আমার দেশের প্রতিটি মানুষ খাদ্য পাবে, আশ্রয় পাবে, উন্নত জীবনের অধিকারী হবে—এই হচ্ছে আমার স্বপ্ন।’ ১৯৭২ সালের জুন মাসে এক ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভাবেই দেশ ও দেশের মানুষকে নিয়ে তাঁর স্বপ্নের কথা বলেছিলেন।

পাঁচ দশক আগে বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্নের বাংলাদেশ কল্পনা করেছিল আজ তার অনেকটাই বাস্তব রূপ লাভ করেছে। মাথাপিছু আয়, জিডিপি, রপ্তানি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গড় আয়ু, দারিদ্র্য বিমোচন—উন্নয়নের প্রতিটি সূচকে বাংলাদেশ এগিয়েছে।

১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির আয়তন ছিল আট বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্তমানে এর আয়তন ৪৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ উন্নীত হয়েছে মধ্যম আয়ের দেশে।

অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে এগিয়েছে বাংলাদেশ।

শুরুতে কৃষি খাত বড় ভূমিকা রাখলেও আশির দশক থেকে অর্থনীতিতে মূল ভূমিকা রাখতে শুরু করে শিল্প খাত। আরো নির্দিষ্ট করে বললে তৈরি পোশাক খাত।

কিন্তু কৃষিও আগের জায়গায় বসে নেই। গত পাঁচ দশকে কৃষিতে বিপ্লব ঘটে গেছে। বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন বেড়েছে ৫০ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু অর্থনীতির আকার বাড়লেও মূল্যস্ফীতি কমানো যাচ্ছে না। যেমনটা কমানো যাচ্ছে না বিদেশে অর্থ পাচার, বৈশ্বিক সংকটে রিজার্ভের অবস্থাও শঙ্কায়। খেলাপি ঋণ, দুর্নীতি এই সংকটকে আরো বাড়াচ্ছে।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিভক্তির শুরুটা হয়েছিল বৈষম্য থেকে। এখন আমাদের সমাজে উন্নতির পাশাপাশি বৈষম্যও বেড়ে গেছে। অধ্যাপক রেহমান সোবহান এক সাক্ষাৎকারে বলছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু যে সমতাভিত্তিক, শোষণ-বঞ্চনাহীন ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন, এ ধরনের একটি বৈষম্যমূলক সমাজের উত্থান তার সম্পূর্ণ বিপরীত।’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে তিনি দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবেন। অর্থনৈতিক উন্নয়নে তৃণমূলে মানুষের অবস্থার উন্নতি হয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতিতে তারা স্বস্তিতে নেই। গরিবের মুখের হাসি দীর্ঘস্থায়ী করা না গেলে স্বাধীনতার যে আনন্দ সেটি পূর্ণ রং পায় না।

অর্থনৈতিক অগ্রগতির পাশাপাশি স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সামগ্রিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি স্পষ্টত সার্বিক অগ্রগতির নির্দেশ করে। বাংলাদেশ গত ৫০ বছরে মানবসম্পদ সূচকেও গুরুত্বপূর্ণ উন্নতি করেছে। এই উন্নতির পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে মূলত শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নতি।

সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় সরকার প্রায় দেড় কোটি জনগণকে নানা ধরনের সুরক্ষা দিচ্ছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার পাঁচ লাখ সাত হাজার ২৪৪টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। মুজিববর্ষে এক লাখ ৮৩ হাজার ৩০০ পরিবারকে দুই শতক জমিসহ সেমিপাকা বাড়ি তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। বিজয়ের পাঁচ দশকে আমার দৃষ্টিতে সরকারের সবচেয়ে বড় সামাজিক উদ্যোগ এটি। প্রায় ৫৮ লাখ লোককে বয়স্ক ভাতা দেওয়া হচ্ছে। ২৫.৭৫ লাখ বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলার জন্য ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১৭১১.৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে বাজেটে।

সামাজিক অগ্রগতির সবচেয়ে বড় সূচক শিক্ষা। শিক্ষা ক্ষেত্রে গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের অর্জন কম নয়। বিশেষ করে শতভাগের কাছাকাছি শিশুদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে পারাটা সরকারের বড় অর্জন। ২০১৩ সালে ২৬ হাজার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকার একযোগে জাতীয়করণ করেছেন। ২০২৩ সালে চার কোটি ২৭ লাখ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীর হাতে ৩৫ কোটি ১৬ লাখ পাঠ্যপুস্তক বিনা মূল্যে তুলে দেওয়া হয়েছে। এক কোটি ৩২ লাখ প্রাথমিক শিক্ষার্থী সরকারি উপবৃত্তি কার্যক্রমের আওতায় এসেছে। ছয় লাখ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীসহ উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়েও সরকার এই কার্যক্রম সম্প্রসারিত করেছে।

ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি ডিজিটাল ক্লাস রুম, প্রাথমিকে শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনুপাত হ্রাস করাসহ একাধিক উদ্যোগ দৃশ্যমান। পাবলিক সার্ভিস কমিশন বিসিএস নন-ক্যাডার থেকে প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন। প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ফলে খুব দ্রুত না হলেও এসব সমন্বিত পদক্ষেপগুলোর একটি ফল শিক্ষা ক্ষেত্রে আমরা আশা করতে পারি। মেধাপাচার রোধ আর উচ্চশিক্ষায় শৃঙ্খলা আনা গেলে সত্যিকার অর্থেই শিক্ষায় একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।

আমাদের বাজেটে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয় মৌলিক প্রয়োজনকে। পাশাপাশি আমাদের উচিত বরাদ্দের একটা বড় অংশ সাংস্কৃতিক চর্চায় ব্যয় করা। এটিকে ব্যয় না বলে ভাবতে হবে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিনিয়োগ হিসেবে। প্রতিটি উপজেলায় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিতে হবে। শুদ্ধ সংস্কৃতির বিস্তার তৃণমূলে ছড়িয়ে দিতে হবে। আবহমান বাংলার যে সংস্কৃতি সেগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আমাদের ইতিহাসে রাষ্ট্রের বহুমাত্রিক সংকটে সবার আগে প্রতিবাদমুখর হয় সাংস্কৃতিক কর্মীরা। তাই এই খাতে প্রণোদনা না দিলে, জাতীয় বাজেটের ন্যূনতম ১ শতাংশ বরাদ্দ না দিলে রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক পাটাতন মজবুত হবে না। সাংস্কৃতিক জিডিপি বৃদ্ধি করতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধের ৫২ বছরে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে নানা পরিবর্তন এলেও আমাদের রাজনীতি এখনো আবর্তিত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে। মুক্তিযুদ্ধে কার কী ভূমিকা ছিল, স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি—এগুলোই সব সময় আমাদের রাজনীতির মূল প্রশ্ন। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ সরকার প্রায় দেড় দশক ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায়। দীর্ঘদিন ধরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকার ফলে রাষ্ট্রের ব্যাপক ভৌত উন্নয়ন ঘটেছে। বলা যায়, বদলে গেছে বাংলাদেশ। কিন্তু এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের মানস জগতের পরিববর্তন কতটা হয়েছে, সেই প্রশ্নও চলে আসে।

তারুণ্যের হাত ধরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এই তরুণরাই ছিল আমাদের মূল ভরসা। এই তরুণদের ওপর নির্ভর করছে আগামীর বাংলাদেশ কেমন হবে সেটি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ এসব বিষয়ে আমাদের তরুণ প্রজন্মের মাঝে দ্বিধাবিভক্তি লক্ষণীয়। রাষ্ট্রের মৌল বিষয়ে এই বিভক্তি কিংবা বিভ্রান্তি টেকসই মানবিক উন্নয়নের অন্তরায়। এই বিভক্তি রাষ্ট্রে তৈরি করেছে রাজনৈতিক বিভাজন। একদিকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আবার অন্যদিকে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি।

বিজয় দিবস উদযাপনের পরপরই বাংলাদেশের তরুণদের দিতে হবে ভোটের পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলবে, অন্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে—এমন জনপ্রতিনিধি আমাদের নির্বাচন করতে হবে। আমার আজকে যে রূপান্তরিত অদম্য বাংলাদেশকে দেখছি তা তরুণদের হাত ধরে আরো এগিয়ে যাবে—বিজয়ের দিনে এটাই প্রত্যাশা।

(লেখক : ট্রাস্টি সম্পাদক, গণহত্যা জাদুঘর)

About Syed Enamul Huq

Leave a Reply